লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া আমাকে এগিয়ে নিয়েছে: ইমরান
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সহকারী পরিচালক’ (২০২২ ব্যাচ) পদে চাকরি পেয়েছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের জকিগঞ্জ থানার কলাকুটা (কাজী বাড়ি) গ্রামে। তিনি ইছামতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর সিলেটের এমসি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: বেশ ভালো লাগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। নিজের অনেক চেষ্টা এবং আল্লাহর রহমতে এ জায়গায় আসতে পেরেছি।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় কয়েকজন মিলে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। কিছুদিন পর মনে হলো অনার্সের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করবো। এরপর আইবিএর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। তখন অনেকে আমাকে নিরুৎসাহিত করে বলেছিলেন, আইবিএতে সাধারণত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিতে চায় না। যতই ভালো পরীক্ষা দিই না কেন ফাইনালি তারা নেবেন না। এসব শোনার পর আইবিএতে পড়ার ইচ্ছে অনেকটা মিইয়ে আসে। ওই সময় থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে ব্যাংকের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। ব্যাংকের প্রস্তুতি যখন শুরু করি; তখন থেকেই মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদের প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে সব সময়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম পরীক্ষা দিয়েছিলাম অফিসার জেনারেলের। সেখানে লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। তাই নিজের ভেতর একটা জেদ ঢুকে যায়। ঢাকা থেকে সিলেট ফেরার পথে বাসে বসে বসেই প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে চাকরি করবোই।
আরও পড়ুন: পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়া ছেলেটি এখন ‘ইলিয়াস স্যার’
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: আইবিএর জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় ম্যাথ এবং ইংরেজি শেষ করে ফেলেছিলাম। ইংরেজি গ্রামারের বেসিক আমার খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু আমি ইংরেজি গ্রামারের জন্য প্রচুর সময় দিয়ে নিজেকে মজবুত একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছিলাম। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রস্তুতি শুরু করি। টানা ৬ মাস শুধু ব্যাংকের ম্যাথ করি। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে আমি সিলেট কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করি। লাইব্রেরির পরিবেশটা বেশ চমৎকার ছিল। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত টানা ৮ ঘণ্টা লাইব্রেরিতে দিয়েছি। লাইব্রেরিতে নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম এবং বিশেষ করে সম্পাদকীয় অংশ ভালো করে দেখতাম। এটি আসলে সব শিক্ষার্থীর পড়া উচিত। আমি নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতাম। মডেল টেস্ট দেওয়ার কারণে প্রশ্ন সমাধান করার ক্ষমতা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। আমার আরেকটি ভালো গুণ হলো, কবিতা ও গল্প লিখতে পারতাম। এই গুণ পরীক্ষার হলে কাজে লাগিয়ে বাংলা রচনা কিংবা অনুবাদে বেশ ভালো করতে পারতাম। পাশাপাশি সময়কে খুব কাজে লাগিয়েছিলাম। দিনে লাইব্রেরিতে রাতে বাসায় পড়তাম।
আমার কাছের বন্ধুদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে চাই, কারণ তারা আমাকে অনেক সময় ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, কী করছি? তখন বলতাম, মুভি দেখছি। আসলে তখন আমি পড়তাম। তাদের থেকে লুকিয়ে অনেক পড়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া আমাকে এগিয়ে নিয়েছে। আমার একটা খাতা ছিল, যার ওপরে লেখা ছিল ‘রোড টু বিবি এডি’। খাতার মধ্যে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর নোট করে রাখতাম। প্রতি শুক্রবার পুরো এক সপ্তাহের নোট পড়তাম। খাতাটি বেশ সাহায্য করেছে। সাধারণ জ্ঞান আমার কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং বিষয়। একটা সিরিজের বই বেশ ভালো করে পড়ে ফেলেছিলাম। তাই সাধারণ জ্ঞান আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। একটা সময় যখন লাইব্রেরিতে পড়তে যেতাম; তখন অনেকে আমাকে সাধারণ জ্ঞান, বাংলা সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্য থেকে অনেক প্রশ্ন করতেন। আমি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর নিমিষেই দিয়ে দিতাম। প্রশ্ন করে আটকাতে পারতেন না। তাই অনেকে মজা করে আমাকে ডাকতো জীবন্ত উইকিপিডিয়া।
ভালো চাকরির জন্য ভালো প্রস্তুতির বিকল্প নেই। আর ভালো প্রস্তুতির জন্য অবশ্যই বেশি করে সময় দিতে হয়। আমি প্রচুর সময় দিয়েছি। আমার পরিবার আমাকে খুব সাপোর্ট করেছে। প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আমি পারিবারিক কোনো কাজ করিনি, তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাইনি। এরকমও দিন গিয়েছে আমি বাসা থেকে বেরই হইনি। তবে এটি শুধু ব্যাংকের প্রস্তুতির জন্য নয়, সাথে বিসিএসের প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। আমি ৪০তম ও ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডার এবং ৪৩তম বিসিএসের ভাইভা দিয়েছি। সব মিলিয়ে বলতে হয়, আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আর রিজিকের মালিক মহান রাব্বুল আলামিন আমাকে উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: বারবার অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে: মোহন আহমেদ
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে সব সময় কারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: আমার পরিবার। আমি আমার পরিবারের কাছে আজন্ম ঋণী। আমার পরিবার বলতে, আমি ছোট বেলা থেকে বড় হয়েছি আমার নানা বাড়িতে। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর নানি আর খালা-মামাদের কাছে বড় হই। তাদের দেওয়া পারিবারিক শিক্ষা আমার হাতেখড়ি। তারাই আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে নতুনরা কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: নতুনদের জন্য সর্বপ্রথম পরামর্শ হলো চোখ-কান খোলা রেখে পড়তে হবে। মুখস্থ না করে বুঝে বুঝে পড়তে হবে। যারা একেবারেই নতুন তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনারা প্রথমে একটি প্রশ্ন ব্যাংক কিনে প্রশ্ন সমাধান করেন। প্রশ্ন সমাধান করলে ব্যাংকের পরীক্ষার ধরন সম্পর্কে ধারণা হবে। বেশি বেশি করে পত্রিকা পড়বেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি একটি পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করবেন এবং অনুবাদ করবেন নিজের মতো করে। বেশি বেশি করে মডেল টেস্ট দেবেন। একদম প্রস্তুতির শুরু থেকেই মডেল টেস্ট দেবেন। অনেকের ধারণা, মডেল টেস্ট দিতে হয় প্রিপারেশন সম্পূর্ণ হওয়ার পর কিন্তু আদৌ প্রিপারেশন কখনোই সম্পূর্ণ হয় না। তাই শুরু থেকেই মডেল টেস্ট দেওয়া শুরু করলে আপনার নিজের অবস্থান আপনি নিজেই জানতে পারবেন। মডেল টেস্ট থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর নোট করে রাখবেন। যাতে চোখ বোলালেই যেন মনে পড়ে যায়। যারা ম্যাথে দুর্বল তারা অবশ্যই ম্যাথের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। ম্যাথ ছাড়া ব্যাংকের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. ইমরান উদ্দিন চৌধুরী: বাংলাদেশ ব্যাংকের হয়ে কাজ করে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে চাই। পাশাপাশি ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিজেকে যথাযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
এসইউ/এমএস