ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাগো জবস

জীবনের শেষ বিসিএস জয়

রুটিনমাফিক পড়াশোনার চেষ্টা করেছি: পিংকি রানী মজুমদার

আনিসুল ইসলাম নাঈম | প্রকাশিত: ০২:৪৬ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

পিংকি রানী মজুমদার ৪১তম বিসিএসে বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার শাকপুর ইউনিয়নের জাগুরিয়া (ধলিরপাড়) গ্রামের মেয়ে। বাবা দুলাল চন্দ্র মজুমদার দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। মা মমতা রানী মজুমদার একজন গৃহিণী। পড়াশোনায় অমনোযোগী মেয়েটি দুরন্ত শৈশব পার করেছেন। দুষ্টুমি আর খেলাধুলা নিয়ে তার সময় পার হতো। পড়াশোনার জন্য তার মা তাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেখানে শাসন-বারণের মাঝেই চলে পড়াশোনা, দুষ্টুমি, সোনালি শৈশব। তিনি গালিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বরুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি পাস করেন। বরুড়া শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান এবং স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।

সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: ৪১তম বিসিএসে বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
পিংকি রানী মজুমদার: সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমি যে বিসিএস বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি, তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ৪১তম বিসিএস আমার শেষ বিসিএস ছিল। তাই ক্যাডার হওয়ার বিষয়টা আমার কাছে সুখকর ছিল। পরিবেশ ও বনায়ন নিয়ে কাজ করার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। বন ক্যাডার পাওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আমার সেই পথ সুগম করে দিয়েছেন। আমার এ সাফল্যে বাবা-মা অনেক খুশি হয়েছেন। এতেই আমি অনেক আনন্দিত। বাবা-মায়ের সুখই আমার সুখ। তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই আমার সফলতা।

আরও পড়ুন: পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়া ছেলেটি এখন ‘ইলিয়াস স্যার’

জাগো নিউজ: বিসিএস দেওয়ার ভাবনা মাথায় এলো কিভাবে?
পিংকি রানী মজুমদার: ২০১৬ সালে জুলাই মাসে মাস্টার্স শেষ করি। যেহেতু ডিপার্টমেন্টে পজিশন ছিল। তাই ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে ভাইভা দিয়েছিলাম, কিন্তু চাকরি হলো না। বুঝতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আরও কিছু যোগ্যতা লাগে। কিছুটা হতাশ হলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বিসিএস ক্যাডার হবো। আমি ৩৮তম বিসিএস থেকে লক্ষ্য স্থির করে পড়াশোনা শুরু করলাম।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?
পিংকি রানী মজুমদার: বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রত্যাশা থাকার কারণে প্রস্তুতি আমার কিছুই ছিল না। কিভাবে শুরু করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কাছের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। আমি ৩৮তম বিসিএসে লক্ষ্য স্থির করে পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রথমে জব সল্যুশন পড়া শুরু করলাম। ফলে বিসিএস প্রশ্ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাই। প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম গণিত এবং ইংরেজিতে অনেক দুর্বলতা আছে। দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য দুই বিষয়ে আরও দ্বিগুণ সময় দিয়েছি। একই সঙ্গে বিভিন্ন চাকরির প্রিলি পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু কোনো প্রিলিই পাস করতে পারছিলাম না। একটি নয়, দুটি নয়; একের পর এক ৩৬টি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রিলি পাস করতে পারিনি আমি। কিন্তু হার মেনে নিইনি, দমেও যাইনি। আমার কাছে নো মানে নেক্সট অপরচুনিটি। আমি চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে অবশ্যই পারবো, অবশ্যই সফল হবো।

অবশেষে ৩৭ নম্বর চাকরির পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো প্রিলি পাস করি। এরপর থেকে মোটামুটি সব প্রিলি পরীক্ষায় পাস করতে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পাস করি। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। প্রিলিমিনারির জন্য আমি বাজারের একটি বইয়ের সিরিজ অনুসরণ করি। সেই সঙ্গে কোচিং করি এবং নিয়মিত নোট করে পড়াশোনা করি। প্রতিটি বিষয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে সামনে এগিয়েছি। সব সময় রুটিনমাফিক পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। এরপর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সাইফুল ইসলাম সুফল ভাই (৩৬তম বিসিএস-প্রশাসন ক্যাডার) এবং মোস্তফা স্যারের কাছ থেকে লিখিতের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নিই। প্রথমেই বিগত সালের প্রশ্নগুলো সমাধান করে নিই। লিখিত প্রস্তুতির জন্য আমি প্রতিদিন ১৫ মিনিট করে যে কোনো একটি টপিকের ওপর বাংলা এবং ইংরেজিতে ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং প্র্যাকটিস করেছি। পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম ও আন্তর্জাতিক অংশগুলো নিয়মিত পড়েছি। বিভিন্ন উক্তি বারবার পড়েছি, যাতে ভুলে না যাই। ইংরেজি পত্রিকা থেকে অনুবাদ চর্চা করেছি নিয়মিত। গণিতের জন্য নবম ও দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত ও বাজারের একটি বই ফলো করতাম। যেহেতু আমি গণিতে দুর্বল ছিলাম। তাই গণিতের জন্য কোচিং করি। বিজ্ঞান আমি বিভিন্ন বই থেকে নোট করে পড়েছি এবং চিত্রগুলো বার বার চর্চা করেছি। বিভিন্ন ডাটা মনে রাখার জন্য বার বার ডায়াগ্রাম ও পাই চার্ট ব্যবহার করেছি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির টপিক অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে ছোট করে নোট সাজিয়ে ছিলাম, যেন রিভিশন করতে সহজ হয়।

আরও পড়ুন: ভাইভা বোর্ডে ফার্স্ট ইম্প্রেশন বেশ গুরুত্বপূর্ণ

৩৮তম বিসিএসে লিখিত পাস করে ভাইভাতেও উত্তীর্ণ হই। ফলাফল নন-ক্যাডার লিস্টে জায়গা হয়। কিন্তু দুঃখ তখনো রয়ে গিয়েছিল। কারণ ক্যাডার হতে পারিনি। অন্যদিকে অনেক ভালো প্রিপারেশন নিয়েও দুর্ভাগ্যবশত ৪০তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ফেল করি। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ চাকরির বয়স শেষের দিকে ছিল। ৪১তম বিসিএস ছিল আমার শেষ বিসিএস। ৪০তম বিসিএস প্রিলি ফেল করে হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। অনেক কষ্টে হতাশা কাটিয়ে উঠলাম। শেষবারের মতো ৪১তম বিসিএসের জন্য চেষ্টা শুরু করি। লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাব না, এটাই ছিল আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় শেষ বিসিএসে সফলতার সঙ্গে প্রিলি, লিখিত এবং ভাইভা উত্তীর্ণ হই। অবশেষে বিসিএস বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। ভাইভা প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নিয়মিত ইংলিশ স্পোকেন প্র্যাকটিস করেছি। প্রতিদিন নিয়ম করে একটি ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকা পাঠ্যতালিকায় রেখেছি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন লেখকের বই, জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্তারিত পড়ার চেষ্টা করেছি। চয়েস লিস্টের প্রথম দিকের ক্যাডারগুলো সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বিস্তারিত স্ট্যাডি করেছি। সেই সঙ্গে নিজ জেলা, বর্তমান চাকরি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পঠিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি।

জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
পিংকি রানী মজুমদার: ৩৬তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত সুফল ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছি। সেই সঙ্গে বাবা-মায়ের কষ্টগুলো আমাকে ক্যাডার হওয়ার জন্য মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। আমার স্বামী সব সময় পাশে থেকে সব ধরনের সাপোর্ট দিয়েছে ও উৎসাহিত করেছে।

জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
পিংকি রানী মজুমদার: অনার্সে যারা আছেন, তারা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে ইংরেজি ও গণিতের যে কোনো একটি প্রকাশনীর বইয়ের সাহায্য নিয়ে বেসিক দক্ষতা বাড়িয়ে রাখতে পারেন। তবে একাডেমিক পড়াশোনার যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। পিএসসির প্রিলিমিনারি এবং রিটেনের সিলেবাসটি অবশ্যই ভালোভাবে বুঝতে হবে। সিলেবাসের টপিক অনুযায়ী পড়াশোনা করা উচিত। বিগত সালের প্রশ্ন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য একটি জব সল্যুশন পড়ে শেষ করা এবং সেই সঙ্গে নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করতে হবে। নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা করতে হবে, লক্ষ্য নিয়ে কৌশলগত পরিশ্রম করলে সফলতা অবশ্যই পাওয়া যায়। সব সময় স্মরণ রাখতে হবে, সফলতার শর্টকাট কোনো পথ নেই। তবে বিসিএস ছাড়াও বিকল্প চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। আমি মনে করি, দিন শেষে বিসিএস একটি চাকরি মাত্র। জীবনের ছোট্ট একটি অংশ, এটি সম্পূর্ণ জীবন নয়। তাই যতটা বিনয়ী, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং ডাউন টু আর্থ থাকবো; ততই শান্তি পাবো বলে বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
পিংকি রানী মজুমদার: যেহেতু বন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। তাই দেশের বনজ সম্পদ রক্ষা, উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে অবদান রাখতে চাই।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন