ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাগো জবস

বিসিএস ক্যাডার

প্রশাসন পররাষ্ট্র ও পুলিশে এত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কেন?

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৪৫ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২৩

সাইফুল ইসলাম

শিরোনাম দেখে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদের মেধা দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ বা পররাষ্ট্র ক্যাডার পেয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু জাতি যে আস্তে আস্তে মেধাবীদের হারাবে, সে কথা অনেকে চিন্তা করলেও তা রয়ে গেছে আড়ালেই। যে শিক্ষার্থীর হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার বা যাদের হাত ধরে গড়ে উঠতে পারতো আধুনিক নগর বা বড় বড় মনোমুগ্ধকর স্থাপনা। কিন্তু সমাজের চাহিদা পূরণে তারা আজ প্রশাসন কিংবা পুলিশ ক্যাডার। তাহলে চার বছর ধরে যে শিক্ষার্থী প্রশাসন পরিচালনায় জ্ঞান অর্জন করেছে, তার ঠিকানা কোথায়? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশাসনে বা পুলিশেই চাকরি করবে, তাহলে তাদের পেছনে সরকারের কোটি টাকা খরচ করার কোনো কারণ দেখছি না।

সম্প্রতি বহুল প্রতীক্ষিত ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এ বছর ২,৫৩৬ শূন্য পদের বিপরীতে ২,৫২০ জনকে বিভিন্ন পদের জন্য নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। বিসিএসের দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ অনেক দিনের, তা নিয়ে আজ আলোচনা করবো না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিসিএস ক্যাডার হওয়া অনেক সম্মানের। চাকরির বাজারে প্রতি বছর যে হারে শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়, তার তুলনায় সরকারি শূন্যপদ খুবই অপ্রতুল। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরি যেন সোনার হরিণ। যেমন কদর বেড়েছে সরকারি চাকরিজীবীর; ঠিক তেমনই বিসিএস ক্যাডারদেরও কদর দ্বিগুণ বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বিসিএসের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে, তা বেশ কয়েকটি বিসিএসের আবেদন সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ২০১০-২০১২ সালেও বিসিএসের আবেদন সংখ্যা ছিল লাখের ঘরে। এখন তা কয়েকগুণ বেড়ে ৪-৫ লাখ হয়েছে। এত আগ্রহের পেছনে অনেক কারণ আছে। সে কারণ অনুসন্ধান আমার মূল উদ্দেশ্য নয়।

এবার আসি সম্প্রতি ঘোষিত বিসিএসের ফলাফল নিয়ে। এবারের বিসিএসে প্রশাসনে ৩২৩ জন, পুলিশে ১০০ জন, পররাষ্ট্রে ২৫ জনসহ সাধারণ ক্যাডারসমূহে প্রায় ৮০০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। বিসিএস কেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপের প্রাপ্ত তথ্য মতে, সাধারণ ক্যাডারের প্রায় সিংহভাগই ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের জয়জয়কার। শুধু এ বিসিএসে নয়, বিগত ৪-৫টি বিসিএসেও একই চিত্র। এবারের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রথম থেকে সপ্তম মেধা তালিকা পর্যন্ত বুয়েটের দখলে আর মোট ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জনেরও বেশি বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের। সংখ্যাটি যদি এমন হতো, ২০ জনই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। তাহলে কেমন হতো? এর উত্তর আমরা পরে পাবো। এবার প্রশাসন ক্যাডারের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। এখানেও ইঞ্জিনিয়ারদের আধিক্য। বুয়েট থেকে প্রশাসন ক্যাডারে ৪৫ জন, চুয়েট থেকে ২০ জন, বুটেক্স ও কুয়েট থেকে ২০ জন, শাবিপ্রবি থেকে ৮ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়রিং বিভাগগুলো থেকে প্রায় ৩০ জন, এমআইএসটি থেকে ৩ জন, হাবিপ্রবি থেকে ৩ জন। বাকিদের সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি।

আরও পড়ুন: বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই বিসিএস ক্যাডার মুন্নী

এ তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয়, পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও করসহ রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আগামী কয়েক বছর ইঞ্জিনিয়ারদের জয়জয়কার অবস্থা থাকবে। একথা অকপটে স্বীকার করতে হবে যে, দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়াশোনা করে। যেহেতু তারা সবচেয়ে মেধাবী, স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো পরীক্ষায় ভালো করবে। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা হয়তোবা আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারবো না। কেননা যারা গত কয়েক বছর ধরে বিসিএসে জয়েন করেছেন; তারা নেতৃত্ব পর্যায়ে যেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। বাংলাদেশে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়ানো হয়। সরকার প্রতি জনের পেছনে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ করে। চার-পাঁচ বছর ধরে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ে যদি বিসিএস ক্যাডারে অন্য পেশায় জয়েন করেন, তাহলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়। কারণ তার শিক্ষালব্ধ জ্ঞান জাতির জন্য কোনো কাজে আসে না। যারা এ পেশায় থাকেন, তাদের বেশিরভাগই পাড়ি জমান উন্নত বিশ্বে।

বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হলেও এখনো বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজের জন্য উন্নত রাষ্ট্র থেকে ইঞ্জিনিয়ার আনতে হয়। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল যে প্রকল্পই বলুন না কেন, দেশের চেয়েও বিদেশিদের আধিক্য। চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলার কিছুই নেই। সেটি জাতির সামনে স্পষ্ট। বছরের পর বছর উন্নত চিকিৎসার জন্য এমপি, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষও পাড়ি জমান ভারত, সিঙ্গাপুরসহ উন্নত বিশ্বে। এ প্রচলন বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক ভারতে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। এতে অর্থ ও সময় দুটোই নষ্ট হয়। কেন এত সংখ্যক লোক বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর কারণ খুঁজে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। অপ্রতুল চিকিৎসক, যন্ত্রপাতির সংকটসহ নানা সংকটে ভুগছে চিকিৎসা খাত। ভোগারই কথা, কেননা দেশের মেধাবী ডাক্তাররা যে আজ প্রশাসন ক্যাডারে বা পুলিশ ক্যাডারে চাকরি করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান।

বর্তমান সরকার সবকিছুতেই স্পেশালাইজদের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ যে যে কাজের জন্য পারদর্শী; তাকে সে কাজে নিয়োগ দেওয়া, একজন ডাক্তারের বা ইঞ্জিনিয়ারের কাজ যেমন সমাজবিজ্ঞানী করতে পারবে না; তেমনই একজন প্রশাসকের বা পররাষ্ট্রের কাজও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে ওই বিষয়ে দক্ষ বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থী ভালোভাবে সামলাতে পারবেন। বর্তমানে একটি তেরো গ্রেডের কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দিতে গেলেও সরকার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খোঁজ করে। সঙ্গে কম্পিউটারের দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়। অথবা সহকারী জজ নিয়োগেও শুধু আইনের ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাহলে কেন প্রশাসনে লোকপ্রশাসন বা জনপ্রশাসন বা সমাজবিজ্ঞানীদের আধিক্য থাকবে না? আপতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যে কেউই প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবেন, কিন্তু একজন প্রশাসনের শিক্ষার্থী চার বছর ধরে ম্যাক্স ওয়েবারের আমলাতন্ত্র, টেইলরের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বা মোটিভেশন তত্ত্বসহ মানুষকে চালনা করার নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। পরে তাকে নন-ক্যাডারেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শুধু লোকপ্রশাসন নয়; রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা পাঁচ বছর ধরে এসব বিষয়ে পড়ালেখা করে পরে খালি হাতে পিএসসি থেকে ফিরতে হয়।

আরও পড়ুন: বাবার অনুপ্রেরণায় বিসিএস ক্যাডার মানস

গত কয়েক বছরের ফল দেখলে বোঝা যায়, প্রশাসন ক্যাডারে লোকপ্রশাসনের বা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই-তিন শতাংশের বেশি হবে না। যদি ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তাররা প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ভালো পরিচালনা করতে পারতেন, তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইআর বা লোকপ্রশাসনের উদ্ভব হতো না। অবশ্য এজন্য শিক্ষার্থীদের দোষ নেই। কারণ বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থা হয়ে গেছে বিজ্ঞাননির্ভর। যেখানে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বেশি সুবিধা করতে পারে। যদি ১৩ গ্রেডের একজন কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগে তার দক্ষতা যাচাই করা হয়। তাহলে যারা সামনে জাতির রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি বা প্রশাসন চালাবে; তাদের প্রশাসনিক জ্ঞানেরও পরীক্ষা নেওয়া উচিত। বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা বর্তমানে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক। পিএসসির উচিত হবে ভবিষ্যতের বিসিএসগুলোয় প্রশাসন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক লিখিত পরীক্ষায় আরও বেশি মার্কস বরাদ্দ করা। সেখানে তত্ত্ব ও প্রায়োগিক বিষয়গুলোর মেধা যাচাই করা। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যেমন ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া নিয়োগ দেওয়া হয় না। সহকারী সিভিল সার্জনে যেমন এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া নিয়োগ দেওয়া হয় না। তেমনই আমরাও চাই প্রশাসনে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীদের আধিপত্য থাকুক। পিএসসির উচিত হবে এ নিয়ে নতুন করে ভাবার। তা না হলে একটি সময় দেশ যেমন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হারাবে; ঠিক তেমনই তারা প্রশাসনে গিয়েও অবশ্যই যে চার বছর ধরে প্রশাসন নিয়ে পড়ে এলো তার চেয়ে ভালো বুঝবেন না।

আমি দেখেছি, লোকপ্রশাসন থেকে অনেক শিক্ষার্থী পিএসসিতে ভাইবা দিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। হয়তোবা পিএসসির কাছে তাদের মেধাকে তুলে ধরার সুযোগ পাননি। বিপরীতে ঠিকই দেখেছি ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাক্তারদের প্রশাসন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে আধিক্য। পিএসসির উচিত হবে অনতিবিলম্বে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে যুগোপযোগী করে তোলা। যাতে যার যে কাজে পারদর্শিতা আছে, তাকে সে পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারে। এতে দেশ ও জাতি উভয়ই লাভবান হবে।

লেখক: প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন