সফলতার জন্য কঠোর অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই
ড. মো. হাসানুর রহমানের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। তিনি ২০০২ সালে মাধ্যমিক এবং ২০০৪ সালে পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০০৫ সালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদে ভর্তি হন। সফলতার সঙ্গে স্নাতক শেষ করে ২০১০ সালে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি জাপানের টোকিও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদের হর্টিকালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার শিক্ষকতার গল্প, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও তরুণদের পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: শিক্ষকতা পেশায় আসার গল্প শুনতে চাই—
ড. মো. হাসানুর রহমান: শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটি আমার কাছে একটি ব্রত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। মূলত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমার বাবা চাইতেন, আমি যেন আদর্শবান মানুষ হই এবং আদর্শবান মানুষ গড়ার কারিগর হই। বাবার সেই ইচ্ছেটা আমাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি অনেকটাই আগ্রহী করে তোলে। তা ছাড়া শিক্ষকতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননে এক্সেপশনাল বা ব্যতিক্রমী বিষয়গুলো প্রবেশ করিয়ে নিয়মের পুরোনো শেকল ভেঙে নতুন করে চিন্তা করতে শেখানো যায়। যা শিক্ষকতার প্রতি আমার আগ্রহের অন্যতম কারণ।
জাগো নিউজ: আপনার কর্মজীবনের গল্প শুনতে চাই, কেমন উপভোগ করছেন?
ড. মো. হাসানুর রহমান: শিক্ষকতা পেশার অন্যতম সুবিধা হলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা যায়। মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতামত শেয়ার করা কিংবা তাদের নতুন নতুন বিষয় জানাতে বা পড়াতে আমার অনেক ভালো লাগে। এ ছাড়া একজন শিক্ষক আজীবন শিক্ষার্থী। আমি মূলত শিখতেই বেশি পছন্দ করি। এই শিক্ষকতা পেশাই আমার অনুসন্ধিৎসু মনের তৃপ্তির খোরাক জোগায়। সব মিলিয়ে আমি আমার কর্মজীবন খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করছি।
জাগো নিউজ: এতদূর আসার পেছনে কার কাছ থেকে সব সময় অনুপ্রেরণা পেতেন?
ড. মো. হাসানুর রহমান: আমার এতদূর আসার পেছনে সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আমার বাবা ও মা। এ ছাড়াও আমার দুজন কাজিন, মাসুদ এবং খোরশেদ ভাইও উৎসাহ জুগিয়েছেন। আমার স্কুলজীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষক আছেন, যারা সব সময় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে বিধান চন্দ্র হালদার স্যার ও আনিস খান স্যারের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়াও আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, যাদের সহযোগিতা এবং দোয়া আমাকে এ পর্যায়ে আসতে অনেক সাহায্য করেছে।
জাগো নিউজ: আধুনিক বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে কেন, কী কী ঘাটতি আছে?
ড. মো. হাসানুর রহমান: বিভিন্ন কারণেই আধুনিক বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ গতানুগতিক শিক্ষার কাঠামো। শিক্ষাখাতে আমাদের রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়লেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলো হলো পুঁথিগত শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া, শিক্ষকের এবং পাঠক্রমের মানোন্নয়ন না করা, পুরোনো শিক্ষার কাঠামো থেকে বের না হওয়া এবং শিক্ষাখাতে প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণাধর্মী শিক্ষার অভাব।
জাগো নিউজ: এসব বিষয়ে উন্নতি করতে হলে কোন কোন বিষয়ে ফোকাস দেওয়া উচিত?
ড. মো. হাসানুর রহমান: আমি মনে করি, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিতে গবেষণার বিকল্প নেই। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক, ক্লাসরুমসহ ল্যাবের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যা বাস্তবমুখী শিক্ষা কার্যক্রমকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে আমাদের কারিগরি শিক্ষার ওপর নজর দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার যে প্রবণতা রয়েছে, সেখান থেকে বের করে আনতে হবে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা অনেক এগিয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের সেই পুরাতন কারিকুলামেই পড়াতে হচ্ছে। যার অনেক কিছুই এখন কোনো কাজেই আসছে না। চিরাচরিত বক্তৃতা পদ্ধতিতে পড়ানো থেকে বের হয়ে শিক্ষকদের শিক্ষাদান পদ্ধতির অন্যান্য যে ধরন বা পদ্ধতি আছে; সেগুলোর অনুশীলন করতে হবে। তাতে যেমন শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল শক্তিকে বের করে নিয়ে আসা সম্ভব হবে; তেমনই প্রত্যেক শিক্ষার্থী সহজেই উপকৃত হবে। বর্তমান আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষককে একজন ফ্যাসিলিটেটর (সহায়তাকারী) হিসেবে গণ্য করা হয়। এজন্য শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সর্বোপরি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে।
জাগো নিউজ: একজন শিক্ষার্থীর সফলতার জন্য কোন কোন বিষয়গুলো অনুসরণ করা উচিত?
ড. মো. হাসানুর রহমান: একজন শিক্ষার্থীর সফলতার জন্য নিয়মিত কঠোর অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। তার জীবনের একটি লক্ষ্য স্থির করে সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করা উচিত। আমাদের সবার একজন আইডল থাকা উচিত। যিনি সত্যিকার অর্থেই শুধু একজন সফল মানুষ নন, একজন পরিপূর্ণ মানবিক মানুষও বটে। সততা অনেক বড় একটি বিষয়, যা একজন মানুষের শিক্ষাজীবন থেকে কর্মক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী খারাপ সঙ্গের কারণে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের বলবো এসব বিষয়ে অবশ্যই কঠোর সতকর্তা অবলম্বন করতে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে যুক্ত রাখা অনেক ভালো বলে মনে করি। সফলতার জন্য সময়ের যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব জরুরি।
জাগো নিউজ: শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ড. মো. হাসানুর রহমান: প্রথমত, কিছু ভালো মানের শিক্ষার্থী তৈরি করা। যারা দেশ ও মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করবে। এ ছাড়াও আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে, একটি উন্নতমানের প্ল্যান্ট সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করা। যেখানে বিশ্বমানের গবেষণা হবে এবং সেই গবেষণাপত্রগুলো বিভিন্ন নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হবে। যেটি বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
এসইউ/এএসএম