যেভাবে গুগলে চাকরি পেলেন কিশোয়ার শাফিন
ড. কিশোয়ার শাফিনের জন্ম দিনাজপুরে হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার তীব্র আগ্রহ থেকে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) থেকে বিএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান্টা ক্রুজে বায়োমোলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণার প্রতি আগ্রহ থেকেই গুগলের রিসার্চ সায়েন্টিস্ট পজিশনে আবেদন করেন। ইন্টারভিউয়ের ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর সেখানে চাকরি পান। ২০২২ সালের মার্চে তিনি গুগলের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কার্যালয়ে ‘রিসার্চ সায়েন্টিস্ট’ পদে যোগদান করেন।
তার গুগলে চাকরি পাওয়া, নতুনদের জন্য পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুগলে চাকরি পেয়েছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
ড. কিশোয়ার শাফিন: গুগলে কাজের পরিবেশ অসাধারণ, আমার বেশ ভালো লাগছে। অ্যাকাডেমিয়া থেকে বের হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা যে কোনো গবেষকের জন্য একটু ভিন্নরকম হলেও আমি গুগলের যে দলটির সঙ্গে কাজ করছি, তারা অসাধারণ। আমি যেসব বিষয়ে গবেষণা করতে চাই; সেগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই সব মিলিয়ে মানিয়ে নিতে তেমন কষ্ট হয়নি এবং কাজ করে বেশ আনন্দ পাচ্ছি।
জাগো নিউজ: কখন থেকে সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি মনোযোগ দিলেন?
ড. কিশোয়ার শাফিন: প্রোগ্রামিংয়ের শুরু বিএসসি করার সময়। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার আগ্রহ থেকে আমি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) ভর্তি হই। বিএসসি শেষ করার পর আমি এমআইএসটিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। পড়াশোনা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং এবং গবেষণায় আগ্রহী ছিলাম। তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহী করার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়াও এমআইএসটি প্রোগ্রামিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এক বছর দায়িত্ব পালন করেছি। এমআইএসটির হয়ে বেশ কিছু জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি।
জাগো নিউজ: গুগলে চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন?
ড. কিশোয়ার শাফিন: আমি সেভাবে গুগলকে কেন্দ্র করে কোনো প্রস্তুতি নিইনি। মূলত পিএইচডি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে ভালো গবেষক হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলাম। আমার পিএইডির মূল গবেষণার বিষয় হলো কীভাবে নতুন জিনোম সিকোয়েন্সিং টেকনোলজির অ্যানালাইসিস মেথডগুলো ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে উন্নত করা যায়। আমার প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ন্যাচার বায়োটেকনোলজি জার্নালে। আমার দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি গুগলের দলের সঙ্গে ন্যাচার মেথডসে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি যে দলটি প্রথম সম্পূর্ণ হিউম্যান জিনোম ম্যাপ সায়েন্স জার্নালের বিশেষ সংস্করণে প্রকাশ করে, আমি সেই দলের সদস্য।
আমাদের টিম সম্প্রতি ‘টাইম হানড্রেড মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পিপল অব ২০২২’, ‘ন্যাচার সেভেন টেকনোলজিস টু ওয়াচ ইন ২০২২’ এবং দুটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসসহ অগণিত প্রশংসা পেয়েছে। এ ছাড়াও স্ট্যানফোর্ড মেডিসিনের নেতৃত্বে আমরা দ্রুততম সময়ে একজন আইসিইউ রোগীর অসুস্থতার জেনেটিক ডায়াগনোসিস করতে সক্ষম হই। যা আরেকটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান করে নেয়। বিশ্ববিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষণার পাশাপাশি ২০২১ সালে দুটি ইন্টার্নশিপ করি এনভিআইডিআইএ ও গুগলে। দুটি থেকেই ফুল টাইম জবের অফার পাই। আমার গবেষণার বিষয় ও পরবর্তী পরিকল্পনার সঙ্গে গুগলের দলটির কাজে অনেক মিল থাকায় গুগলে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিই।
জাগো নিউজ: গুগলে কী ধরনের চাকরির সুযোগ আছে?
ড. কিশোয়ার শাফিন: গুগল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে বিভিন্ন পদবিতে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। যে কারো যোগ্যতা অনুযায়ী কোন পদে গুগল নিয়োগ দিচ্ছে তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের ওয়েবসাইট।
জাগো নিউজ: একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট গুগলে চাকরির জন্য আবেদন করবেন কীভাবে?
ড. কিশোয়ার শাফিন: নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও আবেদন সম্পর্কে জানার জন্য ভালো উপায় হলো গুগলের ওয়েবসাইট। সেখান থেকে পছন্দের পদটি খুঁজে নিয়ে প্রার্থীর যোগ্যতার সঙ্গে বিজ্ঞপ্তির ন্যূনতম যোগ্যতা মিলে যায় কি না, সেটি দেখে আবেদন করতে পারবেন। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি বিষয়ক ওয়েবসাইট লিঙ্কডইন থেকে গুগলের রিক্রুটারদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে অ্যাপ্রোচ করলে উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গুগলের কোনো দলের কাজের সঙ্গে যদি প্রার্থীর কাজ ও যোগ্যতা পুরোপুরি মিলে যায়, তাহলে সেই দলের কোনো একজন মেম্বারকে সরাসরি অ্যাপ্রোচ করা যেতে পারে ই-মেইল অথবা লিঙ্কডইনে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই কাজের মিল খুঁজে বের করা উচিত।
জাগো নিউজ: গুগলে ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যদি বলতেন—
ড. কিশোয়ার শাফিন: গুগলের সঙ্গে আমার কাজের শুরু ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে। আমার পিএইচডি অ্যাডভাইজরের অনুপ্রেরণায় আমি প্রথমে একটি রিসার্চ এবং একটি টেকনিক্যাল ইন্টারভিউয়ের পর ২০২১ সালের সামারে গুগলে জিনোমিক্স দলের সঙ্গে একটি রিসার্চ ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাই। ইন্টার্নশিপের ইন্টারভিউগুলো ফোনে হয়েছিল, রিসার্চ ইন্টারভিউতে আমার গবেষণার বিষয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। টেকনিক্যাল ইন্টারভিউতে একটি প্রোগ্রামিং সমস্যার সমাধান করতে দেওয়া হয়। কিছু স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালাইসিস থ্রি প্রোবাবিলিটি থেকে প্রশ্ন করা হয়।
ইন্টার্নশিপের শেষে আমি ফুল টাইম রিসার্চ সায়েন্টিস্ট পজিশনের জন্য আবেদন করি। যেখানে আমাকে দুই রাউন্ডে মোট ছয়টি ইন্টারভিউ দিতে হয়। ফুল টাইম ইন্টারভিউ শুরু হয় একটি এক ঘণ্টার প্রেজেন্টেশন দিয়ে। যেখানে আমি নিজের গবেষণার একটি বিষয় অনেক গভীরে গিয়ে ব্যাখ্যা করি। আমাকে ৪-৫টি বিষয় থেকে একটি বিষয় বেছে সেটার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে আমি ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে জিনোম অ্যানালাইসিস উন্নত করার কাজ বাছাই করি। কেননা সেটি আমার কাছে টেকনিক্যালি শক্তিশালী মনে হয়।
প্রেজেন্টেশনের পর আমার দুটি রিসার্চ এবং দুটি প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউ হয়। রিসার্চ ইন্টারভিউতে আমার গবেষণার বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করা হয়। বিশেষত ডিপ লার্নিংয়ে কোন মডেল ব্যবহার করলাম এবং জিনোমিক্সের অন্যান্য অনেক সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যাবে, সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রতিটি রিসার্চ ইন্টারভিউ ডিপ লার্নিং অথবা জিনোমিক্স থেকে অনেক বেসিক প্রশ্ন করা হয়। এখানে আমার গবেষণার বিষয়ে দক্ষতা কেমন, তা যাচাই করা যায়। প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউগুলোতে আমাকে দুই-তিনটি প্রোগ্রামিংয়ের সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আমার বিএসসিতে থাকাকালীন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা অনেক কাজে আসে। এ ইন্টারভিউতে আমার সাধারণ প্রোগ্রামিং দক্ষতা, ডাটা স্ট্রাকচার, ডাইনামিক প্রোগ্রামিং ইত্যাদির পরীক্ষা নেওয়া হয়। তা ছাড়া সমাধান কীভাবে করলাম এবং কোড টেস্টিং নিয়েও কিছু প্রশ্ন করা হয়।
প্রথম চারটি ইন্টারভিউয়ের দুই সপ্তাহ পর আরও দুটি ইন্টারভিউ, একটি কোডিং এবং একটি রিসার্চ ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়। এবারের রিসার্চ ইন্টারভিউটি বেশ অ্যাডভান্সড ছিল। আমার গবেষণার বেশ গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করা হয় এবং ভবিষ্যতে এগুলোকে কীভাবে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। কোডিং ইন্টারভিউটি আগের রাউন্ডের মতো ছিল। কিন্তু এবারের সমস্যার বেশ কিছু এজ কেসেস ছিল; যেগুলো পুরোপুরি বের করতে হয়েছিল ইন্টারভিউ যিনি নিয়েছেন তার সঙ্গে কথা বলে। মোট ছয়টি ইন্টারভিউ ও একটি প্রেজেন্টেশনের দুই সপ্তাহ পর আমি ফুল টাইম অফার পাই। একইসঙ্গে এনভিআইডিআইএ থেকেও অফার পাই। এরপর গুগলের জিনোমিক্স দলের লিডের সঙ্গে কথা বলে আমার দায়িত্ব এবং পরিকল্পনার সঙ্গে দলের কতটা মিল আছে, সেটা জানার চেষ্টা করি। পাশাপাশি রিক্রুটারের সঙ্গে অফার নেগোশিয়েট করি।
সবশেষে যাচাই-বাছাইয়ের পর মনে হয়, এনভিআইডিআইএর দলটি অসাধারণ হলেও আমি যে গবেষণাগুলো করতে চাই; সেগুলোর সঙ্গে গুগলের দলটির মিল থাকায় এটি আমাকে ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তা ছাড়াও আমার ইন্টার্নশিপের সময় জিনোমিক্স দলের সঙ্গে আমার কাজের সামঞ্জস্য থাকায় এবং দলের প্রতিটি সদস্য খুবই সাহায্যপরায়ণ
হওয়ায় আমি গুগলে যোগ দিই।
জাগো নিউজ: পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কতটা সময় লাগতে পারে?
ড. কিশোয়ার শাফিন: পুরো প্রক্রিয়ার সময়কাল ভিন্ন ভিন্ন পদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় দুই মাস এবং অফার নেগোশিয়েশনে এক মাস সময় লেগেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এর থেকে বেশি বা কম সময় লাগতে পারে।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সুযোগ কেমন?
ড. কিশোয়ার শাফিন: বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত নিজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে অনেকেই গুগলে সরাসরি যোগদান করছেন। আমার বিশ্বাস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মানদণ্ডকে উত্তীর্ণ করে এমন অনেক সম্ভাবনাময় ইঞ্জিনিয়ার এবং গবেষক বাংলাদেশে আছে, যাদের প্রয়োজন কিছুটা নির্দেশনা ও আত্মবিশ্বাস। এখন যেহেতু ইন্টারনেট ঘেটেই কীভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে, তা বের করে ফেলা সম্ভব। তাই আমার মনে হয়, এই সংখ্যা দিনে দিনে আরও অনেক বাড়বে।
জাগো নিউজ: যেসব তরুণ গুগলে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
ড. কিশোয়ার শাফিন: প্রথমে টেকনিক্যাল স্কিল ডেভেলপ করার জন্য প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার পাশাপাশি একটি ভালো উপায় হলো বড় কোনো প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করা। নিজের টেকনিক্যাল স্কিলের পাশাপাশি সফট স্কিলস যেমন- কমিউনিকেশন, টিম প্লেয়ার, পারস্পরিক সম্মানবোধ ভালোভাবে পরিচর্যা করা উচিত। মনে রাখবেন, আপনি যেখানে কাজ করেন বা পড়াশোনা করেন; সেখানে কেউ আপনার প্রতিযোগী নন। কোনো সময় যদি মনে হয়, আপনার কোনো একটি বিষয়ে দুর্বলতা কাটানো প্রয়োজন, তাহলে মনে রাখবেন কখনোই ‘অনেক দেরি’ হয়ে যায়নি। নিজ চেষ্টায় এটি যে কোনো সময়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। জীবনকে উপভোগ করুন, কোনো একটি বিষয়কে নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে জীবনকে উপভোগ করতে না পারা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
জাগো নিউজ: গুগলে চাকরি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ড. কিশোয়ার শাফিন: গুগল জিনোম সিকোয়েন্সিংকে জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। যা আমার গবেষণার আগ্রহের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। এর পাশাপাশি জিনোমিক্সের অগ্রযাত্রা যেন সব জাতীয়তার মানুষকে সমানভাবে উপকৃত করে, সেজন্য কাজ করতে চাই।
এসইউ/জেআইএম