পড়াশোনার পাশাপাশি কাঠমুকুটে সফল ঐশী
আনিকা তাবাসসুম ঐশী। জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহী শহরে। বেসরকারি চাকরিজীবী গোলাম কবির ও সরকারি চাকরিজীবী নাসিমা খাতুনের একমাত্র মেয়ে। তিনি বর্তমানে রাজশাহী সরকারি মহিলা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে হয়ে যান উদ্যোক্তা। অল্প সময়েই লাখোপতি হয়ে যান। তিন বছরে প্রায় ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন পেজের মাধ্যমে।
শুরুর গল্প
ছোটবেলা থেকেই ঐশীর ইচ্ছা নিজে কিছু করার। তাই শখ থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রাফটিং করতেন। ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর ঐশী তার মায়ের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইউটিউবে ক্রাফটিংয়ের ভিডিও দেখে হাতে তৈরি গহনা বানানো শেখেন। ২০১৯ সালে কলেজে ভর্তির পর মা-বাবা খুশি হয়ে স্মার্টফোন কিনে দেন। তখন থেকেই ইউটিউব দেখে অবসর সময়ে কাজে লেগে যান। কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের গ্রেটিং কার্ড, হাতে তৈরি গহনা বানিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের জন্মদিন, ঈদ বা বিশেষ দিনে উপহার দিতেন।
ঐশী বলেন, ‘উপহার দেখে বান্ধবীরা ও কাজিনরা আমার হাতের কাজগুলোর অনেক প্রশংসা করত। বান্ধবীরা টুকটাক অর্ডারও দিতো। তারাই মূলত আমার প্রথম ক্রেতা। এভাবেই শুরু হয় আমার উদ্যোগ।’
এগিয়ে চলা
ঐশী কলেজ থেকে পাওয়া বৃত্তির ১০০০ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ফেসবুকে ‘কাঠমুকুট’ নামে একটি পেজ খোলেন ২০১৯ সালে। তখন থেকেই ঐশীর মনে কাজের মাধ্যমে নিজের পরিচয় তৈরি করার ইচ্ছা জাগে। পেজ খোলার একমাস পর নারী উদ্যোক্তাদের ফেসবুক গ্রুপ ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম উইতে জয়েন করেন। সেখানে থেকেই অনলাইন বিজনেস সম্পৃক্ত নানা রকম দিকনির্দেশনা পান।
‘উই’ গ্রুপের মাধ্যমেই বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্যের অর্ডার পেতে শুরু করেন। ঐশী বলেন, ‘যেহেতু উইতে সবাই নিজ জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য নিয়ে কাজ করতেন। আমি রাজশাহীর মেয়ে, তাই সিল্ক নিয়ে কাজ করার একটা আইডিয়া মাথায় এলো। তখনও রাজশাহীর সিল্ক নিয়ে কেউ কাজ করেন না। তাই তখন একা এই সেক্টরে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জের। আমার বাসা থেকে ৩০০ গজ দূরে রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি। যেহেতু রাজশাহী সিল্ক আমাদের জেলার বিখ্যাত পণ্য। তাই দেশবাসীকে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি সম্বন্ধে অবগত করার জন্য আমি রাজশাহী সিল্ক নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’
আর যা নিয়ে কাজ করেন
ঐশীর প্রধান পণ্য রাজশাহীর সিল্ক। ঐশী প্রথমে হাতে তৈরি কাঠের গহনা ও হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি নিয়ে কাজ করতেন। তবে তিনি ব্র্যান্ডিং পান রাজশাহীর সিল্ক নিয়ে কাজ করে। তাই ঐশীর রাজশাহীর সিল্ক এখন প্রধান পণ্য। পাশাপাশি রাজশাহীর মসলিন নিয়েও কাজ করেন।
উদ্যোগের বর্তমান অবস্থা
ঐশীর উদ্যোগটি বর্তমানে অনলাইনেই সীমাবদ্ধ। তার বেশিরভাগ পণ্য স্থানীয় কারখানা থেকেই উৎপাদন করেন। পণ্য তৈরির কাঁচামাল তাঁতিদের থেকে সংগ্রহ করেন। পরে কাপড়গুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেন। এরপর কালার, ডিজাইন, হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক, বাটিক, অ্যাম্ব্রয়েডারি, হাতের কাজ কারিগরকে দিয়ে নিজের ও কাস্টমারদের পছন্দ অনুযায়ী বানিয়ে নেন।
উদ্যোগের পণ্য তৈরিতে ঐশীর ৫ জন কারিগর আছেন। তাদের কাজের ওপর মাস শেষে ৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি দেন। এ ছাড়াও চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন কারখানা থেকে কাজ করিয়ে নেন। অনলাইনের মাধ্যমে কেউ অর্ডার করলে কুরিয়ারের মাধ্যমে তা সারাদেশে পাঠান।
দেশের বাইরে যাত্রা
ঐশী আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান, সাউথ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে ৩০ বারের মতো পণ্য পাঠিয়েছেন। সরাসরি ডিএইচএলের মাধ্যমে বেশকিছু পাঠিয়েছেন। এতে খরচ বেশি হলেও ঝামেলা ছাড়াই ৭ দিনের মধ্যে পণ্য হাতে পান। আবার কিছু ক্রেতা দেশের বাইরে থেকে অর্ডার করেছেন এবং দেশে তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে নিয়ে গেছেন। বিদেশের সব ক্রেতাই প্রবাসী বাঙালি। ঐশী ৫ম বাংলাদেশ-ভারত সাংস্কৃতিক উদ্যোক্তা মিলনমেলা-২০২২ এ অংশগ্রহণ করেছেন।
অনুপ্রেরণা
ঐশীকে সবার আগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তার মা ও বাবা। তাদের অনুপ্রেরণা ছাড়া তিনি এতদূর আসতে পারতেন না বলে মনে করেন। তারপর তিনি আরেক শুভাকাঙ্ক্ষীর নাম বলেন, তিনি উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা। তিনিও ঐশীকে নানা রকম পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
ভবিষৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যতে ঐশী পণ্য প্রোডাক্টশনে আরও জনবল নিয়োগ করে অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান। তার ব্যবসার পরিধি বাড়াতে এবং কাজকে গতিময় করতে কাঠমুকুটের শো-রুম করতে চান। যেন ক্রেতারা শো-রুমে এসে পণ্য কিনতে পারেন। তিনি কাঠমুকুটকে সিল্কের ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
এসইউ/এমএস