শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএসের স্বপ্নপূরণ মিলির
নাহিদা সুলতানা মিলি ৩৮তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায়। পরে ঢাকার মতিঝিল এজিবি কলোনিতে চলে যান। তার বাবা মো. খুরশিদ আলম পিডব্লিউডিতে কর্মরত (অবসরে) ছিলেন। মা রাজিয়া সুলতানা একজন গৃহিণী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বড় নাহিদা সুলতানা মিলি। ২০০৭ সালে টিঅ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয় মতিঝিল থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ৩৬তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে ‘ট্যাক্স ইন্সপেক্টর’ পদে এবং ৩৭তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে ‘উপজেলা সমাজসেবা অফিসার’ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি সরকারি সফর আলী কলেজ নারায়ণগঞ্জে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, সফলতার গল্প ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প শুনতে চাই—
নাহিদা সুলতানা মিলি: আমার শৈশবের ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত কাটে গ্রামে। গ্রামের আর কয়েকটা মেয়ের মতোই সেই দুরন্ত শৈশব কেটেছে। মধ্যদুপুরে মার চোখ ফাঁকি দিয়ে একবাড়ি থেকে আরেকবাড়ি ঘুড়ে বেড়ানো, বাড়ির পাশের পুকুর অথবা খালের পানিতে সাঁতার কাটা, বড় আপুদের সাথে পুতুল খেলা, ছোটমামার সাথে তিন গোয়েন্দার মতো রোমাঞ্চকর জায়গা আবিষ্কার করা, চড়ুইভাতি ও এক্কাদোক্কা খেলেই দিন পার হতো। তবে এত কিছুর মধ্যেও আম্মু আমার পড়াশোনার ব্যাপারে আপোসহীন ছিলেন। যাই হোক, পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেই ঢাকায় মোটামুটি স্থায়ী নিবাসী হয়ে যাই। পঞ্চম শ্রেণিতে না পড়েই পরের বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এসএসসি শেষ করে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হই। এভাবে শহুরে জীবন শুরু হয় আমার। এজিবি কলোনিতে শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্য মিলে প্রায় ১৬ বছর কাটাই। কলোনিতে থাকার সুবাদে আমার শহুরে পরিবেশের মধ্যেও গ্রামীণ একটা ছায়া খুঁজে পাই। আজও স্মৃতিকাতর হই সেসব দিন আর বন্ধু-বান্ধবদের ভেবে।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
নাহিদা সুলতানা মিলি: পড়াশোনায় আমার প্রতিবন্ধকতা তেমন ছিল না বললেই চলে। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েনের মধ্যে আম্মু ও আব্বু সব সময় ভালোটা খাইয়েছেন ও পরিয়েছেন। কখনো অভাব বুঝতে দেননি। তবে একটি সময় আমি নিজেই বুঝতাম সহপাঠীরা যেখানে ৩-৪টি প্রাইভেট পড়ছে, আমার মতো পরিবারের মেয়ের এতটা বিলাসিতা উচিত নয়। অন্তত বাবার সরকারি বেতনের টাকায় নয়। বন্ধুরা যে সময়ে বাংলা কোচিংয়ে ক্লাস শুরু করছে; আমিও ঠিক সেই সময়ে বাংলা বই নিয়ে নিজে নিজেই পড়ার চেষ্টা করতাম। আমার পড়া ধরার শিক্ষক ছিলেন আমার মা। এভাবেই এসএসসিতে একজন শিক্ষক আর এইচএসসিতে খুব কম প্রাইভেট পড়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সকাল ৭টায় বের হতাম টিউশন শেষ করে, ভার্সিটিতে ৯টার ক্লাস ধরতাম। শেষ বিকেলের দিকে আবার ফিরে দুই থেকে তিনটি টিউশন শেষে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত। এ ব্যস্ততার মধ্যেও ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেইনি। নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বই ঘেঁটে আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রতিটি কোর্সের নোট করতাম। এটা সত্য যে, পড়াশোনার পেছনে দিন রাতের সিংহভাগ সময় ব্যয় করতাম। এই ব্যস্তময় জীবন উদ্বিগ্নতায় রূপ নেয় যখন আমার বিয়ে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের তড়িঘড়ি শুরু হয়। অনার্স ১ম বর্ষের শেষের দিকে বলতে গেলে আমার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ আর বাবার ভালোবাসাটা আমাকে হয়তো সেই শিকল থেকে বের করে আনে।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
নাহিদা সুলতানা মিলি: প্রকৃতপক্ষে আমাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার চেয়ে ভার্সিটির টিচার হওয়ার স্বপ্ন বেশি তাড়া করত। তাই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। তাই আমার পড়াশোনা পুরোটাই ডিপার্টমেন্ট কেন্দ্রীক ছিল। চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। অবশ্য অনার্স শেষের দিকে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিসিএস কেন্দ্রীক পড়াশোনার প্রাবল্য দেখে নিজের মধ্যে তখন থেকে ইচ্ছা জাগ্রত হয়। কিছুদিন পড়াশোনা করে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
নাহিদা সুলতানা মিলি: যেহেতু রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমার পঠিত বিষয় ছিল এবং বিসিএসের সিলেবাসের বড় একটি অংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাসের সঙ্গে মিল আছে। তাই ডিপার্টমেন্ট পড়াশোনায় ফাঁকি দেইনি বলে বিসিএসের সিলেবাস অনেকটাই কাভার হয়ে যায়। আবার অনার্স ১ম বর্ষ থেকে টিউশন করাতে গিয়ে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ে আমার ভালো একটা দখল তৈরি হয়। এ ছাড়াও ভার্সিটিতে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ, বরেণ্য ব্যক্তিদের বক্তৃতা শোনা, ইংলিশ আড্ডা, এলআইসিটি কোর্স, আইএমএলে ইংরেজি ভাষার কোর্সে অংশগ্রহণ করার সুবাধে পরোক্ষভাবে বিসিএস প্রস্তুতিতে কাজে লাগে। যেটি রিটেন এবং ভাইবার সময় বুঝতে পারি। এ ছাড়াও ইংরেজি মুভি যেমন- শেক্সপিয়র, জেন অস্টিনসহ এমন অনেক বিখ্যাত লেখকের নাটক, উপন্যাস কেন্দ্রীক মুভিগুলো দেখার অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। পরে এগুলো আমার ইংরেজি ভাষা জ্ঞান বৃদ্ধি, ইংলিশ লিটারেচার ও বাংলা সাহিত্য প্রস্তুতিতে অনেকটা সাহায্য করে। দেশ-বিদেশের জার্নাল, আর্টিকেল পড়ার অভ্যাস থাকায় বিসিএসের প্রস্তুতিতে অনেকটা ভূমিকা রাখে। নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। নিয়ম করে রুটিন মেনে প্রতিটি সময় ও কাজ ভাগ করে সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করতাম।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
নাহিদা সুলতানা মিলি: ৩৬তম থেকে আমার বিসিএস যাত্রা শুরু। এ ক্ষেত্রে আমার মায়ের কষ্ট, পরিশ্রম আর আত্মত্যাগ সঙ্গে আমার ছোট দুই ভাই বিশেষ করে, সবার ছোট ভাই বেশি অনুপ্রেরণার দিয়েছেন। ৩৮তম বিসিএস ভাইবার আগে আমার সঙ্গে যোগ হন আমার স্বামী। যিনি নিজেও একই বিসিএসের প্রার্থী ছিলেন। এককথায় পুরো পরিবার আমার সঙ্গে ছিল।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
নাহিদা সুলতানা মিলি: নতুনরা বিশেষ করে অনার্স প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে যারা, তারা ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনার পাশাপাশি ইংরেজি আর গণিত বিষয়টি চর্চার জন্য কিছু সময় বের করতে পারলে অনেকটাই এগিয়ে থাকতে পারবেন। প্রতিদিন পনেরো-বিশটি করে ভোকাব্যুলারি, গ্রামারের কিছু রুলস বা ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং। গণিতের জন্য ৯ম-১০ম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড বইগুলো চর্চার পরামর্শ থাকবে। নিয়মিত খবর দেখা ও পত্রিকা পড়ে সাম্প্রতিক বিষয় টুকে রাখার অভ্যাস করতে হবে। আশা করি এভাবে পড়ালেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে প্রিলি পাস করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
নাহিদা সুলতানা মিলি: প্রিলিতে একটু সময় নিয়ে বিস্তারিত পড়লে প্রিলি পাস সহজ হয়, সঙ্গে রিটেনেও কাভার হয়ে যায়। এ ছাড়াও রিটেনে বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞানের জন্য বিশেষকরে ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ার অভ্যাস করা উচিত। এটি অনুবাদের জন্য অনেক ফলপ্রসূ।
জাগে নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
নাহিদা সুলতানা মিলি: ভাইবার জন্য ডিস্কাশন তথা কথা বলার চর্চায় মনোযোগী হওয়া উচিত। সেটি গ্রুপে হতে পারে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হতে পারে অথবা মোবাইলে ভিডিওর মাধ্যমে। আমি এ তিনটিই অনুসরণ করতাম। এ ছাড়াও নিজের পঠিত বিষয় ভালো আয়ত্তে থাকলে ভাইবা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। কারণ ভাইবায় নিজের পঠিত বিষয়ের ওপর প্রশ্ন বেশি করা হয়ে থাকে।
জাগো নিউজ: একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নাহিদা সুলতানা মিলি: শিক্ষক হিসেবে প্রধান লক্ষ্য একজন প্রিয় শিক্ষক হয়ে ওঠা। ভবিষ্যতে উচ্চতর ডিগ্রির পরিকল্পনা আছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের গুণগত মান বৃদ্ধি, আনন্দদায়ক ও অংশগ্রহণমূলক পাঠ পরিকল্পনার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।
এসইউ/জেআইএম