ব্যাংকে ক্যারিয়ার গড়তে ইফতে সামের পরামর্শ
ইফতে সাম বিন কাদেরের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী শহরে হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকায়। বাবা মরহুম মো. গোলাম কাদের পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। মা হোসনেয়ারা কাদের গৃহিণীর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ইফতে সাম ২০০৭ সালে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অফিসার (জেনারেল)’ পদে কর্মরত। এর আগে সোনালী ব্যাংকে ‘অফিসার’ পদে এবং জনতা ব্যাংকে ‘সিনিয়র অফিসার’ পদে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তার ব্যাংকে চাকরি, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব কেমন কেটেছে?
ইফতে সাম বিন কাদের: জন্মের পর থেকে আমার সময় কেটেছে ঢাকার মিরপুর এলাকায়। প্রাক প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হই কসমিক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে ভর্তি হই ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের ছিলাম। শহরে বড় হলেও আমার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে খেলার মাঠে। দিনে অবসর পেলেই দলবল জুটিয়ে খেলতে চলে যেতাম স্কুল কিংবা পাড়ার মাঠগুলোয়। পড়ালেখায় প্রথম সারির না হলেও প্রথম দশজনের তালিকায় নিয়মিতই ঘোরাঘুরি করা হতো। ছোটবেলা থেকেই শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রচুর গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ছিল।
জাগে নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?
ইফতে সাম বিন কাদের: দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আমি বাবাকে হারাই। পিতৃহীন পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কারণটি সামনে এলেও মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং হার না মানা সংগ্রাম সেটিকে কখনোই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসতে দেয়নি। সেই দুঃসময়ে আমাদের টিকে থাকার সংগ্রামে ক্রমাগত মানসিক এবং আর্থিক শক্তির জোগান দিয়ে গেছেন আমার চাচারা, ফুপু এবং নানা-নানি। তাদের অনস্বীকার্য অবদানের কারণেই সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
ইফতে সাম বিন কাদের: বাবাকে হারানোর পর যিনি আমাদের পরিবারের প্রতি সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন (চাচা); তার স্বপ্নকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে আমি যখন এইচএসসির পর আইএসএসবি (সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষা) থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসি; তখন তিনিই আমাকে স্বপ্ন দেখান ব্যাংকের চাকরির। তার উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি পরিবারে চাচি ও আপুর ব্যাংকের চাকরি করার দৃষ্টান্ত, নিরপেক্ষভাবে তুলনামূলক কম সময়ে নিয়োগ পাওয়ার ব্যাপারটিও আমাকে ব্যাংকে চাকরির প্রতি আকৃষ্ট করে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প শুনতে চাই—
ইফতে সাম বিন কাদের: এসএসসির পর কলেজে প্রথম বর্ষ থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশন করতাম। ফলে হাতখরচ জোগানের পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতির সাথে পথচলাটাও শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। পরিবারে ব্যাংকার থাকায় তারাও যথেষ্ট দিকনির্দেশনা দিতেন। তাদের দিকনির্দেশনায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মূলত গণিত এবং ইংরেজি পড়াতাম। ফলে অনার্সের পর যখন মূল চাকরির প্রস্তুতির সময় আসে; তখন আমি অন্যদের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে থেকেই শুরু করতে পেরেছিলাম। ব্যাংকে চাকরির প্রস্তুতিতে গণিত এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান এবং কম্পিউটারের জ্ঞানও থাকতে হয়। চাকরির প্রস্তুতির দৌড়ে লক্ষ্যের প্রতি সিরিয়াসনেস হারিয়ে ফেলায় বেশ কয়েকবার গ্রুপ স্টাডি শুরু করার পরও সেখান থেকে ছিটকে গেছি। তবে প্রস্তুতির ব্যাপারে কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কোচিংয়ের সাথে জড়িত হইনি। এ ছাড়াও জীবনের টার্নিং মুহূর্তে বাস্তবতার আঘাত এবং একই সময়ে খুব কাছের বন্ধুকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হয়ে ওঠার পুরো যাত্রা খুব কাছে থেকে দেখা আমার চাকরি পাওয়ার পেছনে অন্যতম মূল টনিক হিসেবে কাজ করেছে।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে অনুপ্রেরণা দিতেন কারা?
ইফতে সাম বিন কাদের: অনুপ্রেরণার বদলে অস্তিত্ব রক্ষার কারিগর বললেই সেটি বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। ব্যাপারটির কারিগর হচ্ছেন আমার মা। বাবার মৃত্যুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের সাংসারিক চাপ তিনি আমাকে অনুভব করতে দেননি। ফলে অনেকটা নির্ভার ভাবেই আমি চাকরির প্রস্তুতি নিতে পেরেছি। অনার্স শেষ করার পর মাস্টার্স চলাকালীন বা বেকারত্বের সময়টায় আমার সামর্থের ওপর বিশ্বাস এবং সমর্থন রেখে যে পরিমাণ সময়-সুযোগ আমাকে দিয়েছেন ফুপু এবং চাচারা; সেটি শুধু অনুপ্রেরণাই নয়, তার থেকেও অনেক বড় পাওয়া। তবে আক্ষেপ একটাই, আমার লক্ষ্য পূরণের সফলতা তাদের বেশিরভাগই দেখে যেতে পারেননি।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্রে নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ইফতে সাম বিন কাদের: আজকালের চাকরিপ্রত্যাশীরা অনেক বেশি অগ্রসরমান। তারা অনার্স শেষ করার অনেক আগে থেকেই জবের প্রিপারেশন শুরু করে দেন। কিন্তু আমার মনে হয় অনার্স শেষ করার পরপরই জবের প্রিপারেশনটা জোরেশোরে শুরু করা উচিত। তবে যাদের একমাত্র লক্ষ্যই সরকারি চাকরি, তারা অনার্সের সময়টায় বেসিক ঠিক করার জন্য টিউশন করাতে পারেন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান পড়ালে বেসিকের অনেকখানি উন্নতি হওয়া সম্ভব। তবে জবের প্রিপারেশন শুরু করার পর কখনোই শর্টকাট খোঁজার চেষ্টা করা উচিত নয়। ইংরেজি, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞানের বেসিক শক্ত হলে সেটি শুধু ব্যাংক নয় বরং বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরির পরীক্ষায় সহযোগিতা করবে। তাই বেসিক ঠিক করার জন্য শুরুতে একটু বেশি সময় লাগলেও সেই সময়টা দেওয়া উচিত লম্বা সুবিধা ভোগ করার জন্য। আর যেহেতু ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষার জন্য খুবই কম সময় (২-৩ সপ্তাহ) পাওয়া যায়, তাই প্রিলির প্রস্তুতির সময়েই যথাসম্ভব বিস্তারিত জেনে রাখা উচিত।
জাগো নিউজ: ব্যাংকের ভাইভা প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
ইফতে সাম বিন কাদের: ভাইবার জন্য যেহেতু কোনো নির্ধারিত সিলেবাস নেই। তাই ভাইবার পুরো ব্যাপারটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। তবে বেশিরভাগ ভাইবায় প্রাধান্য দেওয়া হয় নিজের সাবজেক্টের ওপর, নিজ জেলা কিংবা নামের তাৎপর্যের ওপর, ব্যাংকিং সেক্টরে আসার কারণ, বাজেটের বিবরণ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তবে ভাইবার প্রস্তুতি হিসেবে যে কাজটি মূলত করা যেতে পারে, সেটি হলো ক্রিটিকাল সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখার প্রস্তুতি এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলেও সেখান থেকে ভদ্রভাবে নিজেকে সরিয়ে আনার দক্ষতা আয়ত্ত করা।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইফতে সাম বিন কাদের: যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরত আছি। তাই নিজের মেধা, মনন ও বিচক্ষণতাকে শাণিত করে একজন দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কয়েক বন্ধু মিলে খোলা ভ্রমণ গ্রুপ ‘The Xplorers’ এর কার্যক্রমকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে ভ্রমণশিল্পকে বিকশিত করার পেছনে ভূমিকা রাখতে চাই।
এসইউ/জেআইএম