ব্যাংকে চাকরির জন্য গণিত ও ইংরেজিতে দক্ষতা জরুরি
মুহাম্মদ সাকিউর রহমানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরে। বাবা মো. আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা আক্তার জাহান গৃহিণী। তিনি ২০০৯ সালে নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি এবং ২০১১ সালে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ চট্টগ্রাম থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘অফিসার (জেনারেল)’ পদে কর্মরত। সম্প্রতি তার ব্যাংকে চাকরি, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই—
সাকিউর রহমান: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগাম শহরে। আমি কখনো কোনো বেসরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়িনি। প্রাইমারি স্কুল শুরু করেছি শহরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে। উচ্চ বিদ্যালয়ে উঠে যোগ দেই রেড ক্রিসেন্টের সাথে। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে; তখন শ্রুতিলেখক হিসেবে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। ছোটবেলায় গল্প-উপন্যাস পড়ার অভ্যাস ছিল। পাশাপাশি কবিতাও লিখতাম।
জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
সাকিউর রহমান: তেমন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে আমার এইচএসসির রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার পর এইচএসসিতে পেলাম জিপিএ ৪.৭০। তখন নিজের মধ্যে খুব হতাশা ছিল। দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো একটায় পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেগুলোয় গ্রেড পয়েন্ট কম থাকায় অ্যাপ্লাই করতে পারিনি। আবার চুয়েটে অ্যাপ্লাই করতে পারলেও ফাইনালি এক্সাম দেওয়ার জন্য সিলেক্টেড হইনি। এ কারণে অনেকটা জেদ করেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগ পেয়েও বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে এসে ভর্তি হই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেশন জটের কবলে পড়তে হয়। বিবিএ-এমবিএ ফলাফল প্রকাশসহ আমাদের লেগেছে ৭ বছর ৮ মাস। আগে বের হলে হয়তো ক্যারিয়ারের শুরুটা আরও আগেই হতে পারত।
জাগো নিউজ: ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
সাকিউর রহমান: সত্যি বলতে, বিবিএ পড়ার সময় ভাবতাম প্রাইভেট জব করবো। নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করার স্বপ্ন ছিল। বিবিএর শেষদিকে এবং এমবিএর শুরুর দিকে প্রাইভেট চাকরির সার্বিক অবস্থা দেখে সরকারি চাকরির জন্য প্রিপারেশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেশন জটের কারণে ভার্সিটি থেকে বের হতে দেরী হওয়ায় এবং বিসিএস একটু দীর্ঘ প্রসেস বিধায় সরকারি ব্যাংক এবং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো পছন্দের শীর্ষে ছিল। তার মধ্যে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যতম।
জাগো নিউজ: ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
সাকিউর রহমান: ছাত্রজীবনে আমি কিছু প্রবন্ধ ও বাইরের দেশের শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট করে দেওয়ার কাজ করতাম। এটি আমার লেখার মান কিছুটা হলেও উন্নত করতে সহায়তা করেছে। প্রস্তুতির শুরুর দিকে চট্টগ্রামে এক বড় ভাইয়ের কাছে ব্যাচে ভর্তি হই। ভাইয়া প্রতিদিন কিছু কাজ দিতেন, যেমন- ফোকাস রাইটিং, অনুবাদ ও অন্য টপিক। এগুলো আমি নিয়মিত করার চেষ্টা করতাম।
যখন থেকে সিরিয়াসলি জব প্রিপারেশন শুরু করেছি; তখন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো ডিঅ্যাক্টিভ করে দিয়েছি। কেননা এগুলোয় প্রচুর সময় নষ্ট হতো। চেষ্টা করেছি ঘোরাঘুরি, বিয়ে, জন্মদিনের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে। আমার মনে আছে, বিভাগের র্যাগ ডে অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করিনি।
এমবিএর শেষ ছয়মাস চার বন্ধু মিলে গ্রুপ স্টাডি করতাম এক বন্ধুর বাসায়। সপ্তাহে তিনদিন বসতাম, নিজেরা পড়া সিলেক্ট করে একজন আরেকজন থেকে পড়া জিজ্ঞেস করতাম। এটি আমার প্রিলি প্রিপারেশনে ভালোই হেল্প করেছে। প্রিলির রেজাল্টের পর খুব বেশিদিন সময় পাওয়া যায়নি। সে সময় সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ টপিকের ফোকাস রাইটিংয়ের ওপর জোর দিয়েছিলাম। কী কী টপিক আসতে পারে, এমন একটি তালিকা ফোকাস রাইটিং ও শর্ট নোটের জন্য সাজিয়ে সেগুলোর তথ্যগুলো লিখে রাখার চেষ্টা করি। যে চ্যাপ্টারগুলো থেকে বেশি গণিত আসে, সে চ্যাপ্টারগুলোর রিটেন ম্যাথগুলো রিভিশন দেওয়ার চেষ্টা করি।
রিটেনে কোয়ালিফাইড হওয়ার পর ভাইবার প্রস্তুতি শুরু করি। কেননা এটাই আমার প্রথম ব্যাংক ভাইবা ছিল। আমার সাবজেক্ট রিলেটেড টপিকগুলো পড়েছিলাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক ব্যবস্থা এবং এর খুটিনাটি বিষয়গুলো দেখে যাওয়ার চেষ্টা করেছি।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
সাকিউর রহমান: মা-বাবা দু’জনই অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় সব সময় তাদের কাছ থেকে গাইড লাইন ও সাপোর্ট পেয়েছি। কিছু কাছের বন্ধুও সব সময় সাহস জুগিয়েছে যাতে হতাশ না হই।
জাগো নিউজ: নতুন যারা ব্যাংক চাকরিতে আসতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
সাকিউর রহমান: ব্যাংক জব প্রিপারেশনের জন্য অনার্সের শেষের দিক থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেই হবে। একদম অনার্সের শুরু থেকেই নিজ বিষয়ের পড়া বাদ দিয়ে জব প্রিপারেশন নেওয়ার কোনো মানে নেই। তবে কেউ অনার্সের শুরু থেকেই প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করতে চাইলে আমি বলবো, তার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। কারো গণিতে দুর্বলতা থাকলে সে সপ্তম থেকে নবম-দশম শ্রেণির গণিত বইগুলোর ওপর দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে টিউশন করানো অনেক হেল্পফুল হয়।
ব্যাংক জবের জন্য গণিতের দক্ষতা খুবই জরুরি। প্রিলি ও রিটেনে গণিতে ভালো নম্বর থাকে। তাই গণিত নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। সেক্ষেত্রে বিগত ব্যাংক জবের গণিতগুলো অ্যানালাইসিস করলেই ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। প্রিলির জন্য ইংরেজি গ্রামারের বেসিকের ওপর দখল থাকতে হবে। এ ছাড়া বাংলা ব্যাকরণে প্রিলিতে ভালো নাম্বার থাকে। তাই নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণের বইটি ভালোভাবে আয়ত্তে থাকা জরুরি। সাম্প্রতিক তথ্যের জন্য প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়াই যথেষ্ট। অনেকে কম্পিউটারকে একটু কম গুরুত্ব দেন, কিন্তু এই বিষয়ে প্রায় ৮-১০ মার্ক থাকে প্রিলি পরীক্ষায়। গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো ধরে ধরে বারবার রিভিশন দিলে এই বিষয় সহজ মনে হবে।
যেহেতু প্রিলির রেজাল্টের পর রিটেনের জন্য বেশি সময় পাওয়া যায় না। তাই প্রিলি প্রস্তুতির পাশাপাশি ব্যাংক রিটেনের জন্যও একসাথে পড়তে হবে। নিয়মিত পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামগুলো পড়া বিশেষ করে অর্থনীতি, পরিবেশ, বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ের কলামগুলো। বিজনেস লেটারের ফরম্যাটগুলো সম্পর্কে নলেজ, নিয়মিত অনুবাদচর্চা, ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং প্রাক্টিস একজন প্রতিযোগীকে অন্যদের থেকে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে রাখবে।
জাগো নিউজ: ব্যাংকে ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
সাকিউর রহমান: ভাইবায় সাধারণত নিজের বিষয় রিলেটেড প্রশ্ন আসে। নিজের বিষয়ের মৌলিক কিছু টার্মসের সংজ্ঞা ও ধারণা সম্বন্ধে পুরোপুরি ধারণা থাকা জরুরি। এ ছাড়াও ব্যাংকিং রিলেটেড টার্মস এবং ব্যাংকের খুটিনাটি বিষয়গুলো জানতে হবে। কেননা এ টপিক থেকেও প্রায় প্রশ্ন করা হয়। নিজের সম্পর্কে বলা, নিজ জেলা, নিজের বিষয়কে ব্যাংকের সাথে রিলেট করা, কেন ব্যাংক জবে আসতে চান? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরগুলো আগে থেকেই তৈরি করে নিতে হবে। সর্বোপরি, আত্মবিশ্বাসী মনোভাব নিয়ে ভাইবা বোর্ডে প্রবেশ করতে হবে। যাতে কোনো রকম জড়তা বা নার্ভাসনেস প্রকাশ না পায়।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাকিউর রহমান: নিজের মেধা ও অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চাই। এ ছাড়া আমার বাবার নিজহাতে গড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। যেখানে অনেক অসহায় প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমিও আমার বাবার মতো অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।
এসইউ/জেআইএম