হাওরের ছেলে জুবায়েরের বিসিএস জয়
জুবায়ের সাকি ৩৮তম বিসিএসে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায়। বাবা জাকির হোসেন কৃষক ও মা মরিয়ম একজন গৃহিণী। জুবায়ের ২০১০ সালে দামপাড়া কারার মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১২ সালে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই—
জুবায়ের সাকি: গ্রামেই আমার শৈশব ও বেড়ে ওঠা। আমরা ছিলাম একান্নবর্তী পরিবারের। ফলে অনেক সুখের মধ্যে শৈশব কেটেছে। তাছাড়া হাওরে বাড়ি হওয়ায় অনেক দুরন্তপনার মধ্যে সময় কাটতো। গ্রামের বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। মায়ের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি।
জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
জুবায়ের সাকি: আমাদের গ্রামে হাই স্কুল না থাকায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে বড় একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তাই পড়াশোনার জন্য অনেক দূরের স্কুলে যেতে হতো। এখানে ভালো শিক্ষকের অভাব ছিল। হাওরে হাই স্কুল না থাকায় আমার বন্ধুরা প্রাইমারির পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। আমার মা সেসময় অনেক কষ্ট করেছেন, যাতে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারি। এখন মনে হয়, অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করলে সব প্রতিবন্ধকতা জয় করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
জুবায়ের সাকি: অনার্স ৩য় বর্ষ পর্যন্ত ইচ্ছে ছিল সিএ করবো। এরমধ্যে ৩৬তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমাদের ভার্সিটির অনেক সিনিয়র ৩৬তম বিসিএসে ক্যাডার হন। তখন একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, যারা বিসিএস ক্যাডার হন; তাদের সমাজে অন্যভাবে মূল্যায়ন করা হয়। তাই তখন থেকে সিএ পড়ার আগ্রহ কমিয়ে বিসিএসের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
জুবায়ের সাকি: আমি অনার্স শেষ বর্ষে এক আন্টির সাথে ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করি। তিনি তখন সিএ করছিলেন। তার পরামর্শে আমি সিএ পড়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে পুরোদমে বিসিএস প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। প্রথমে ১০-৩৫তম বিসিএসের প্রশ্ন দেখে বোঝার চেষ্টা করি, বিসিএসে কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্ন দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে বাংলা, গণিত ও ইংরেজিতে বেশি সময় দিতে হবে। তখন শেষ বর্ষের ও বিসিএসের প্রস্তুতি একসাথে নিতে শুরু করি। ফলে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রিলি দেওয়ার পর চিন্তায় ছিলাম পাস করবো কিনা! কিন্তু যখন প্রিলি পাস করলাম; তখন নতুন উৎসাহ নিয়ে রিটেনের জন্য পড়া শুরু করলাম। রিটেন প্রস্তুতির সময় আমার এমবিএ সেমিস্টার ফাইনাল চলছিল। ফলে সময় স্বল্পতায় কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারিনি। বাসায়ই প্রস্তুতি নিতে থাকি। গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করেছি। রিটেনে যত সম্ভব বেশি নম্বর পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তুতি নিই। কারণ রিটেনের নম্বরের উপর ক্যাডার হওয়া নির্ভর করে। রিটেন পরীক্ষায় সব উত্তর করার চেষ্টা করেছি। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য আগে থেকেই সময় বরাদ্দ করে রাখতাম। রিটেন মোটামুটি ভালো হওয়ায় ফলাফল পজিটিভ আসে। ভাইবা একটি মাইন্ড গেম ও ভাগ্যের খেলা। দেখা গেল, অনেক কিছু পড়ে গেলাম কিন্তু সেখান থেকে প্রশ্ন করলো না। তাই ভাইবার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি দরকার। আমার ভাইবা হয়েছিল ১০-১১ মিনিট। স্যাররা অনেক আন্তরিক ছিলেন। সবমিলিয়ে আমার ভাইবা অভিজ্ঞতা ভালো ছিল।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
জুবায়ের সাকি: আমার মা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এমনকি এখনো তিনি আমার সব কাজে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তাছাড়া আমার বড় ভাই বিসিএসের শুরু থেকে সব কাজে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনরা সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন।
জাগে নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন?
জুবায়ের সাকি: বিসিএস প্রিলিতেই দেখা যায় অধিকাংশ পরীক্ষার্থীকে বাদ দেওয়া হয়। তাই ভালো প্রস্তুতির বিকল্প নেই। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো বুঝে বুঝে সমাধান করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলোয় বেশি জোর দিতে হবে। অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর কমন সমস্যা পড়ার পরও মনে না থাকা। এজন্য বেশি বেশি রিভিশন দিতে হবে। সুযোগ থাকলে বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে হবে। এতে পড়া মনে থাকে। তাছাড়া প্রিলি পরীক্ষার আগে মডেল টেস্ট দেওয়া। এতে ভালো ধারণা হয় এবং শেষ সময়ে ভালো প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
জুবায়ের সাকি: বিসিএসে লিখিত নম্বরের ওপর ক্যাডার হওয়া নির্ভর করে। তাই লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব বেশি। রিটেনের সিলেবাস দেখে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নির্বাচন করতে হবে। প্রশ্নের উত্তরগুলো তথ্যমূলক হলে বেশি নম্বর পাওয়া যাবে। সব সাবজেক্টের জন্য আলাদা নোট করলে ভালো হয়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নোট করলে পরীক্ষার আগে দেখে যাওয়া যায়। রিটেনে অল্প সময়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর করতে হয়। তাই সময় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। লেখা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য আগে থেকেই বাসায় প্র্যাক্টিস করতে হবে। আর পরীক্ষার হলে অবশ্যই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
জুবায়ের সাকি: ভাইবায় কী ধরনের প্রশ্ন হয়, তা সব সময় অজানা। তাই যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজের জেলা, নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাডার চয়েজের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। ভাইবা বোর্ডে স্যারদের সঙ্গে বিনয়ের সাথে কথা বলতে হবে। কোনো বিষয় নিয়ে অহেতুক তর্ক বা উত্তেজিত হওয়া যাবে না। সব সময় পজিটিভ চিন্তা করতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
জুবায়ের সাকি: ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কাজ করে যাবো। ভবিষ্যতে পরিবেশ বিষয় নিয়ে বিদেশ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞান নিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই।
এসইউ/জেআইএম