জামদানি শাড়ি নিয়ে সিমির সফল পথচলা
আনিসুল ইসলাম নাঈম
কাজী শাহনেওয়াজ আফরিন সিমির জন্ম পঞ্চগড় উপজেলার গলেহাকান্তমনি গ্রামে। বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মা গৃহিণী। সিমি পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করার। নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর বিবিএস শেষ করেছেন। ইচ্ছা ছিল এমবিএ বা ল’তে পড়ার। কিন্তুু সংসারের নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। চাকরির সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা হয়নি। ঘরে বসেই কিছু করার চিন্তা নিয়ে এগোতে থাকেন।
সেই থেকে সিমি দর্জিকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো ডিজাইনের ড্রেস বানাতেন। সেগুলোয় সুঁই-সুতা দিয়ে হাতের কাজ করতেন। শাড়ি এবং ওয়ালম্যাট তৈরি করতেন। সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসার দিকে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চোখের সমস্যায় সুঁই-সুতার কাজ আর আগায়নি। তখন তার দিন কাটে হতাশায়। কিন্তু সিমি এত অল্পতে দমে যাননি। মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। পরিবার ও সন্তানকে সময় দেওয়ায় বাইরে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। তাই করোনার কথা মাথায় রেখে ভাবেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। সেই থেকে জামদানি ও দেশীয় শাড়ি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ‘জুনাইরাস সিক্রেট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন।
এ প্রসঙ্গে সিমি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুরুতে কিছু শাড়ি কিনে ফেসবুক পেজে ছবি দেই। জামদানি শাড়ির প্রতি আগ্রহ থেকে অনেকে অর্ডার করেন। লকডাউনে মার্কেট বন্ধ থাকায় সবাই অনলাইনে কেনাকাটা করতেন। প্রথমে তেমন অর্ডার আসতো না। কিন্তু করোনার সময়ে বেশি অর্ডার আসতে শুরু করে এবং ভালো বিক্রি হয়। মানসম্মত প্রোডাক্ট বিক্রির কারণে কাস্টমারের চাহিদা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে অর্ডারের পরিমাণও বাড়তে লাগল। কিছু দিনের মধ্যে পেজটি জনপ্রিয় হতে থাকে। অল্প দিয়ে শুরু করলেও এখন প্রতিমাসে আমার অর্ধলাখ টাকার বেশি শাড়ি বিক্রি হয়। হোম ডেলিভারি ও কুরিয়ারের মাধ্যমে কাস্টমারের কাছে শাড়ি পৌঁছে দেই।’
সিমির পেজের সিগনেচার পণ্য ঢাকাই জামদানি শাড়ি। নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লি থেকে শাড়িগুলো আনা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইল ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। এগুলো সংগ্রহ করা হয় হোল সেলারদের কাছ থেকে। শাড়ির জন্য বিদেশ থেকেও অনেক অর্ডার আসে। সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।
কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে সিমি বলেন, ‘প্রথম থেকে কারো কাছ থেকেই কোনো প্রকার সাপোর্ট পাইনি। ব্যবসার শুরুতে মানুষের অনেক কটু কথা ও সমালোচনা শুনতে হয়েছে। জীবনের কঠিন সময় একাই পার করেছি। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়িনি। শত বাধার পরও নিজের দুই সন্তান, সংসার ও ব্যবসাকে সমানতালে চালিয়ে নিয়েছি। স্বামী তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই প্রোডাক্ট সোর্সিং, মার্কেটিং, কাস্টমার দেখাশোনা এবং ডেলিভারি ম্যান—সব কিছু আমাকেই করতে হতো। একমাত্র স্বামীর সাপোর্ট ও নিজের চেষ্টায় শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। তবে ব্যবসায় ভালো করার পর অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন।’
সিমি অনলাইন ব্যবসার পাশাপাশি রান্নাতেও পটু ছিলেন। নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবাই তার রান্না পছন্দ করতেন। বিভিন্ন আইটেমের রান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন। সেই থেকে শখের রান্না নামে আরেকটি পেজ খোলেন। সেখানে বিভিন্ন আইটেমের রান্না করা খাবারের ছবি দেন। পাশাপাশি গরুর মাংস, চিকেন ফ্রাই, চিংড়ির মালাইকারি, মোরগ-পোলাও, নানা ধরনের পিঠা এবং চাইনিজ খাবার রান্না করে থাকেন। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী অনলাইনে খাবার বিক্রি করেন।
সব মিলিয়ে সিমির মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করে একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করছেন। এভাবে সিমির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার স্বপ্ন, উদ্যম আর সাফল্যগাথা দেশের হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে উৎসাহ এবং সাহস জোগাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সিমি বলেন, ‘ব্যবসাকে সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিষ্ঠানকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর স্বপ্ন আছে। পাশাপাশি দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে দোকান দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে।’
এসইউ/এমএস