বিসিএস ক্যাডার হতে ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে : সোহেল আজিজ
এস এম সোহেল রানা, পরিচিতজনের কাছে সোহেল আজিজ। ১৯৮৬ সালের ১৮ আগস্ট বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বেলগাছি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. আব্দুল আজিজ শেখ ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। মাতা মরহুম শেফালী আজিজ ছিলেন গৃহিণী। সোহেল আজিজ মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে প্রাথমিক, শেরপুর ডি জে হাই স্কুল (শেরপুর সরকারি ডি জে মডেল হাই স্কুল) থেকে ২০০২ সালে এসএসসি এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৫-২০০৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
সোহেল আজিজ: তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। সবার আদর-যত্ন পেয়েছি অনেক। বাবা-মায়ের অতি স্নেহ-ভালোবাসায় ছোটবেলা ছিল দুরন্তপনায় মাখা। শৈশবের মধুর সময় কেটেছে পথের পাঁচালীর অপুর মতো। গ্রামীণ প্রকৃতির অসীম স্নেহে শৈশব হয়ে উঠেছিল উড়ন্ত বলাকা। দলবেঁধে বাঙালী নদীতে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, কল্যাণীতে নৌকা বাইচ দেখা, মহিষের গাড়িতে দাদার সাথে হাটে যাওয়া, বাড়ির কুলিতে বদন বা গোল্লাছুট খেলা, কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়ানো কিংবা রোজ বিকেলে আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ আজও মন ছুঁয়ে যায়। আফসোসে ভরে ওঠে সমস্ত হৃদয়। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে নানা বাড়ির বটতলার ‘মাদারের মেলা’ এখনো স্মৃতির জানালায় উঁকি দেয়। তবে বাবা শিক্ষক হওয়ায় পড়াশোনায় ছিল কড়া শাসন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা পড়ার টেবিল হয়ে উঠতো আসামির কাঠগড়া। মাঝে মাঝে খেতে হতো উত্তম-মাধ্যম। অবস্থা বেদিক হলে কখনো বা মা হঠাৎ চিলের মতো ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে যেতেন কাঠগড়া থেকে। বাবা শৈশবের একমাত্র গুরু।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
সোহেল আজিজ: না। তবে ক্লাসে প্রথম হয়েও ক্লাস ফাইভে ও এইটে বৃত্তি না পাওয়া আমার জন্য খুব হতাশাজনক ছিল। তারপরও লেগে ছিলাম, ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম ছিলাম। কিন্তু বিধিবাম ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস অধরাই থেকে গেল। যদিও ওই সময় এ প্লাস ছিল হাতেগোনা। তারপর ২০০৪ সালে বিজ্ঞান থেকে এইচএসসি পাস করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে বিজ্ঞানকে চির বিসর্জন দিয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। তবে সব সিদ্ধান্তে পরিবারের সমর্থন ছিল। পড়াশোনায় বাবা-মা ছিলেন মূল অনুপ্রেরণা।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
সোহেল আজিজ: ২০০৫-২০০৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আবাসিক হলে উঠি। হলে প্রথম দিকে আমি আমার মামাতো ভাইয়ের রুমে ছিলাম। ভাই তখন ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। মূলত ভাইয়ের কাছ থেকেই বিসিএস সম্পর্কে প্রথম বিস্তারিত শুনি। তিনিই আমার মনে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলেন। অনার্স ৪র্থ বর্ষ থেকেই বিসিএস পড়াশোনার হাতেখড়ি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
সোহেল আজিজ: অনার্স পাশের পর পরই প্রথম ৩১তম বিসিএস দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বিসিএসে প্রিলিতে ফেল করি। মূলত একাডেমিক পড়াশোনার চাপেই বিসিএসের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারিনি। তাই মাস্টার্স শেষ করে এক মনে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নযাত্রা শুরু করি। ২০১১ সাল থেকেই নিয়মিত লাইব্রেরি এবং রিডিং রুমে পড়াশোনা করতাম। পাশাপাশি কয়েকজন বন্ধু মিলে গ্রুপ স্ট্যাডি করতাম। ম্যাথ স্ট্যাডি শুরু করেছিলাম ক্লাস সিক্স থেকে টেনের গণিত বই দিয়ে। পাশাপাশি জিআরই ভোকাবুলারি পুরো মুখস্থ করেছিলাম। ফলাফল হাতনাতে পেলাম ২০১২ সালে। ৩৩তম বিসিএস প্রিলিতে উত্তীর্ণ হলাম। কিন্তু রিটেনে ফেল। তারপরও ভেঙে পড়িনি। চারপাশের মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত হতাশার কথা বলতেন। বিশেষ করে আমার বেড মেট। কিন্তু আমি ছিলাম আশান্বিত একজন মানুষ। তখন কাছের কিছু বন্ধু বিসিএসের চোরাবালি থেকে পালিয়ে ক্ষণিক বেকারত্বের তকমা ঘোচানোর আশায় ঢাকার কিছু নামকরা বেসরকারি স্কুল-কলেজে চাকরি শুরু করলো। আমি তখন একা একা অবিচল বেকার থেকেই লাইব্রেরিতে পড়ে রইলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইরা বলতেন, বিসিএস ক্যাডার হতে হলে ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে।
পরিবারের আর্থিক সমর্থন ছিল বলেই অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু পড়াশোনা করেছি। এত চেষ্টার পরও ২০১৫ সালে ৩৪তম বিসিএস ভাইভায় ফেল করি। তবুও লড়াই করেছি সামনে থেকে। ঠিক ওই সময় আমার মা পৃথিবীর ছেড়ে চলে যান। হঠাৎই আমার পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে নেমে আসে হতাশা। শত প্রতিকূলতার মাঝে একদিনের জন্যও বিসিএস থেকে ছিটকে পড়িনি। অবশেষে এই বিচ্ছিন্ন জীবনে এলো এক মাহেন্দ্রক্ষণ। অর্থাৎ আমার স্বপ্নের সারথি ৩৫তম বিসিএসের শুভযাত্রা। নতুন সিলেবাস তাই আগের পড়ার সাথে নতুন কিছু সংযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলো। নতুন সিলেবাসের বই কিনলাম, গণিত প্রাইভেট পড়া শুরু করলাম, কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। এককথায় নতুনভাবে আবার বিসিএস প্রস্তুতির আয়োজন শুরু করলাম। সফলভাবে ২০১৫ সালে প্রিলি ও রিটেন, ২০১৬ সালে ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৭ সালের ২ মে যোগদান করলাম। পুরো বিসিএস জার্নিটা ছিল আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য।
জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?
সোহেল আজিজ: আমি ৩৫তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে আছি। বর্তমানে বগুড়ার সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়? ভাইভার ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন—
সোহেল আজিজ: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড ধৈর্যশীলতা এবং গভীর আত্মবিশ্বাস। এ সময় নিজেকে সব সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। শুধু পড়াশোনায় প্রচুর সময় দিতে হবে। একাডেমিক পড়াশোনা আর বিসিএস পড়াশোনা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথম থেকেই সিরিয়াস হতে হবে। ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়া যাবে না। প্রস্তুতি শুরু করতে হবে বেসিক শক্ত করার মধ্যদিয়ে। এজন্য শুরুতে গণিতের বেসিকের জন্য ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত বোর্ড বই প্রাক্টিস করতে হবে। ক্লাস নাইন-টেনের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বেসিক বই। প্রতিদিন ৫-৬টি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করতে হবে। এতে শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। প্রতিদিন ইংরেজি পত্রিকা পড়তে হবে। রিটেনের জন্য বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়লে ভালো হবে। মাসিক ক্যারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়লে সাধারণ জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি প্রতিমাসে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নগুলো দেখতে হবে।
সব সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হবে, যাতে যেকোন তথ্য সার্চ দিয়ে পাওয়া যায়। এ ছাড়া নিজের ফেসবুক আইডিতে জব বা বিসিএস বিভিন্ন গ্রুপে বা পেজে থাকলে ভালো হয়। নিজেকে সব সময় আপডেট রাখতে হবে। একবারের জন্য হলেও প্রিলি ও রিটেনের কোচিং করা দরকার। এতে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়। কিছু নতুন গাইডলাইন পাওয়া যায়। পাশাপাশি প্রিলি ও রিটেনের জন্য বিসিএস সিলেবাস অনুযায়ী বাজার থেকে মানসম্মত যেকোনো সিরিজের ১ সেট বই কিনে পুরোটা থিউরি একবার পড়া প্রয়োজন। মুখস্থ করার চেষ্টা না করে বুঝে পড়লেই বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়। নিজের মধ্যে প্রচুর তথ্য জানার আগ্রহ রাখতে হবে। আর ভাইভার জন্য সব বিষয়ে সার্বিক ধারণা রাখা প্রয়োজন। যেমন- ক্যাডার চয়েস, নিজের অনার্সের সাবজেক্ট, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়, নিজ জেলা ও উপজেলা, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সরকারের উন্নয়ন সাফল্য, সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলেই ভাইভায় ভালো করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?
সোহেল আজিজ: অবশ্যই আমার বাবা-মার কাছ থেকে। বাবা সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তবে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হবে আমার বড় বোন ও দুলাভাইয়ের প্রতি। পাশাপাশি আমার মাতৃতুল্য খাদিজা খালা, প্রিয় শামসুজ্জামান শাহীন স্যার, সুহৃদ সহকর্মী আবু সাঈদ ভাই এবং অকৃত্রিম বন্ধু মাসুদ, যারা সব সময় আমার পাশে থেকে সুপরামর্শ দিয়ে আমার জীবনে অনন্য অবদান রেখেছেন।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সোহেল আজিজ: একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে শ্রেণিকক্ষে ও শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর উচ্চতর গবেষণা করে দেশের শিক্ষানীতির সংস্কার ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবো বলে আশাবাদী।
জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
সোহেল আজিজ: করোনা দুর্যোগে স্থবির শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমার কলেজে যারা অনলাইন ক্লাসের কার্যক্রম প্রথম শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে আমি একজন। কিন্তু যখন দেখলাম কলেজের এই অনলাইন ক্লাস ছাত্রদের জন্য পর্যাপ্ত নয়; তখন নিজ উদ্যোগে জুমে ক্লাস নিয়েছি। ছাত্রদের চাহিদা মাথায় রেখে ২০২০ সালের মার্চেই ইউটিউব চ্যানেল খুলে প্রতিদিন ক্লাস আপলোড দিয়েছি। আজও আমি আমার অবস্থান থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় করোনা দুর্যোগ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য জুমে ফ্রি ক্লাস নিচ্ছি। ছাত্রদের জন্য নিয়মিত আমার চ্যানেলে ক্লাস আপলোড দিচ্ছি।
এসইউ/এমএস