সাব্বির নাসিরের ক্যারিয়ারের সফলতার গল্প
সাব্বির হাসান নাসির। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সুপারশপ স্বপ্ন’র নির্বাহী পরিচালক তিনি। সংগীতসাধনা তার পারিবারিক রক্তে। গানের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংগীতাঙ্গনে বেশ জনপ্রিয় তিনি। প্রতিভাবান মানুষটি বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়েছেন। আবার ক্যারিয়ারকে বদলে নিতে আইবিএতেও পড়াশোনা করেছেন।
সম্প্রতি তার ক্যারিয়ার ও সফলতা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সমসাময়িক বিষয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বেনজির আবরার—
আপনার পড়াশোনা ও ছোটবেলার কথা শুনতে চাই—
সাব্বির হাসান নাসির: খুলনার একটি প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা পরিবারে আমার জন্ম। পড়াশোনার শুরুটা শহরের স্কুল অব মিউজিকে। এরপর সেন্ট জোসেফ স্কুল। তারপর বিএল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করি। পড়াশোনার বাইরে নিজের ব্যান্ডদল ছিল। নব্বই দশকের ব্যান্ডদল মানেই কিন্তু তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় ভরপুর এক সৃষ্টিশীল সময়।
ক্যারিয়ারের শুরু কোথায় এবং কিভাবে?
সাব্বির হাসান নাসির: বুয়েটে পড়তে চাইনি। পড়তে চেয়েছিলাম পদার্থবিদ্যা। পদার্থবিদ জামাল নজরুল ইসলাম স্যার ইতালি থেকে আরসিএমপিএস ইনস্টিটিউটের জন্য একটি স্কলারশিপ নিয়ে এলেন। তিনি গবেষণা সহকারী খুঁজছিলেন। আমি আবেদন করলাম। পদার্থে না পড়লেও আমার কিছু থিওরি দেখে তিনি পছন্দ করলেন। ফলে জীবনের প্রথম চাকরিও পেয়ে গেলাম। এরপর দুটি পথ তৈরি হয়- গান না হয় রিসার্চ। দুটোর দূরত্ব অনেক বেশি। দুটোই করতে থাকলাম। এরমধ্যে বাটা শ্যুতে ব্যবস্থাপনা শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের সুযোগ পাই। মানে একসাথে তিনটি কাজ! ৯৫ সালে বিয়ে করি। ৯৮ সালে প্রথম সন্তান আর্য নীলের জন্ম। ততদিনে বাটায় একটি অবস্থান হয়ে গেছে। এক বড় ভাইয়ের উৎসাহে আইবিএ-এমবিএতে ভর্তি হই। তখন বাটায় একজন কান্ট্রি ম্যানেজার আসেন ফার্নান্দো গার্সিয়া নামে। বাটার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সুবাদে তার সাথে বিভিন্ন কাজের জায়গাটি বাড়ে।
এরপর ক্যারিয়ার কোন দিকে মোড় নিলো?
সাব্বির হাসান নাসির: প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরিতে কাজ করি ধামরাইতে। আইবিএর ক্লাস ছিল ঢাবিতে! তখনকার প্লান্ট ম্যানেজার সহযোগিতা করায় কাজটি কঠিন হলেও ঠিকভাবে করতে পারি। এরপর চকবাজারে আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয়। তখন ক্লাস এবং চাকরি করাটা তুলনামূলক সহজ হয়ে যায়। এরপর টার্নিং পয়েন্ট! শাপলা ওয়াটার প্রোডাক্টসে জেনারেল ম্যানেজার হই ২০০২-২০০৩ সালে। বয়স কম, এতবড় দায়িত্ব! এর মাঝেই গলফরেট অ্যাঙ্গোলায় কাজের সুযোগ এলো। বিপণন ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি পেলেও প্লান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করলাম। সেখানে গিয়ে তিন মাসের মধ্যে তাদের ভাষা বুঝতে পারা, সব ভাষার মানুষের মধ্যে সুন্দরভাবে সব বোঝাতে পারা আর কাজের আগ্রহের কারণে দ্রুত পরিচিত হয়ে যাই সব জায়গায়। খুব বড় আঙ্গিকে আমাকে বদলে দিলো ইউনিলিভার নেসলে, ক্র্যাফটসের লাইসেন্সি এ প্রতিষ্ঠান। দেশে ফিরলাম কিছুদিন কাজের পর।
এর পরের গল্পটি অনেকেই জানেন। তবুও আপনার কাছে একবার শুনতে চাই—
সাব্বির হাসান নাসির: হ্যাঁ। দেশে ফিরলাম। ডেকো গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক পদে চাকরি পেলাম। তারপর ট্রেটাপেক নামের সুইডিশ কোম্পানিতে। এ প্রতিষ্ঠান আমাকে স্ট্রেন্থ দিয়েছে। দিয়েছে কাজের সুযোগ, পেশাদার হয়ে ওঠার শিক্ষা। এখনো মিস করি সেখানকার সবাইকে। এরপর হঠাৎ একদিন আসবাব ব্র্যান্ড অটবির প্রতিষ্ঠাতা নিতুন কুন্ডুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। কথাবার্তার পর তিনি বললেন অটবিতে যোগ দিতে। প্রথমে না করলেও পরে সিইও পদে জয়েন করলাম।
এ প্রসঙ্গটাই যদি বিস্তারিত বলতেন—
সাব্বির হাসান নাসির: অটবির নিতুন কুন্ডু স্যারের সাথে আমার পরিচয়টা আমার জন্য অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা। তাদের সাথে আমার সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে যায়। নিতুন কুন্ডু স্যারের সাথে পরিচয়ের দিনই তিনি ধরে ফেলেন আমি একজন সংস্কৃতির মানুষ। তার ছেলে, মেয়ে সবার আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমরা পরিবার হয়ে উঠি। তখনো চিন্তা ছিলো না অটবির দায়িত্ব নেওয়ার। একদিন আমাকে ডাকলেন নিতুন কুন্ডু স্যার। একদম হাতে হাত রেখে বললেন, ‘আমি চাই তুমি দায়িত্ব নাও সিইও হিসেবে।’ বিশ্বাস করেন, মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলাম আমি। তার মত বড় শিল্পপতি আমাকে যোগ্য ভাবছেন তার প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার ব্যাপারে! আমি এমন কে যে, তার প্রস্তাব না করি! সে-ই শুরু হলো।
এর তিন মাস পর স্যার দেহত্যাগ করেন। অনিমেষ কুন্ডুকে সমর্থন দেওয়া আর ব্যবসাকে বড় করা নিজের জন্য প্রধান দায়িত্ব মনে হলো। মনে হলো, আমি ৩০০০ পরিবারের অভিভাবক। এরপর অনিমেষসহ অমিতি ও পুরো টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের সবকিছু এত ভালো হয়েছে যে, ২০১১ সালে যখন আমি অটবি ছাড়ি; তখন এটা বিশাল বড় কোম্পানি। অটবি একটা বড় সময় ততদিনে পার করে ফেলেছে। আমি সিইও হিসেবে চেষ্টা করেছি প্রতিষ্ঠানটিতে আমার বাইরে শেখা কালচার প্রতিষ্ঠা করতে। আমি মিশেছি দেশজুড়ে অটবির নানা পর্যায়ের মানুষের সাথে। অনিমেষ, অমিতি ও কর্মীরা সবাই অনেক খেটেছে পুরোটা সময়।
এরপর আবার চলে গেলাম ইউকেতে হাই স্কিল মাইগ্রেশন নিয়ে। কিছুদিন বসে থাকলেও চিন্তা করলাম নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবো। নাম দিলাম রোড ম্যাপ ইউকে লিমিটেড, যার বাংলাদেশ শাখা রোড ম্যাপ বাংলাদেশ লিমিটেড। এটার কাজ ছিলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কনসালটেন্সি করা। আমরা ইউকে আর বাংলাদেশে কিছু কাজও পেলাম। তখন কিছু সময় সুপারশপ ‘স্বপ্ন’র কনসালটেন্সিও করেছে আমার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে আসা হলে তাদের সাথে মিটিংও করেছি। তখনো ভাবিনি ‘স্বপ্ন’ হবে আমার নতুন স্বপ্নপ্রতিষ্ঠান।
স্বপ্ন-তে কখন এবং কেন চাকরি শুরু করলেন?
সাব্বির হাসান নাসির: ২০১১ সালে এসিআই লিমিটেডের গ্রুপ এমডি ড. আরিফ দৌলার সাথে দু’ঘণ্টা আলোচনা হয়। এরপর স্বপ্নের মিটিংগুলাতে কনসালটেন্ট হিসেবে মতামত দিতাম। কিন্তু ঠিক ২০১১ সালের শেষের দিকে স্বপ্নের মত আরেকটি প্রতিষ্ঠান আমাকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বললে আমি স্বপ্নের ঊর্ধ্বতনদের সাথে আলোচনা করি। তারা আমাকে বললেন, আমি যেন স্বপ্নের দায়িত্ব নেই স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। এরপর শুরু স্বপ্নর সাথে পথচলা। এখন পর্যন্ত উপভোগ করছি এখানের সবকিছু। এখানে থাকা অবস্থায় এমআইটি, হাভার্ড, বার্কলে-তে পড়াশোনা করার সুযোগ আমাকে প্রতিষ্ঠানটি দিয়েছে। আমার মত করে অপারেশন চালানোর জায়গাটা দিয়েছে।
‘স্বপ্ন মানুষের ব্র্যান্ড’ বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সাব্বির হাসান নাসির: আসলে সামাজিক উদ্ভাবন স্বপ্নকে এতটা জনপ্রিয় করেছে। এটার দরকার ছিলো এদেশের জন্য, তাই এটি কাজ করেছে।
তরুণরা সঠিক নির্দেশনা না পেয়ে চাকরি দ্রুত পরিবর্তন করে, বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
সাব্বির হাসান নাসির: এটাকে আমি আমাদের ব্যর্থতা মনে করি। কারণ আমরা তাদের জন্য সঠিক কর্মস্থল নিশ্চিত করতে পারছি না। তাদের মধ্যে কাজের স্পৃহা তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানের এইচআর। কালচার যদি ঠিক না করে কেউ প্রতিষ্ঠানে, তবে যত গ্রোথই থাকুক—তরুণরা বা প্রতিভাবান কর্মজীবীরা থাকবেন না।
তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ—
সাব্বির হাসান নাসির: আমি বলবো, প্রথমত স্কিল বাড়াতে ইনভেস্ট করুন। দ্বিতীয়ত, ইমোশনাল এবং সোশ্যাল ইন্টিলিজেন্স বাড়াবেন। এরপর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানুন এবং অবশ্যই নারীদের সম্মান করবেন।
এসইউ/এএ/এমএস