ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এইচআর বিশেষজ্ঞ হলেন যেভাবে
কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের হেড অব এইচআর ও বিএসএইচআরএমের ইসি। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হচ্ছে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। কর্মীদের উন্নয়ন এ বিভাগের কাজের মধ্যে অন্যতম। আর বাংলাদেশে আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এসেছে তার হাত ধরে। তার অভিজ্ঞতা ও ক্যারিয়ারের গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—
আপনার ছেলেবেলা ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—
কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ: জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। পড়াশোনা ছিল ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল এবং নটর ডেম কলেজে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাড়ি জমাই যুক্তরাষ্ট্রে। একটা সময় মনে হয়, আসলে আমি প্রকৌশল বিদ্যার জন্য তৈরি হইনি। আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমত্ববোধ ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও স্বপ্রেরণার পেছনে আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার যে অবদান তা নিয়ে পড়তে থাকি। পৃথিবীর অন্যতম বড় বড় কোম্পানিগুলো কেন এবং কিভাবে এত ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করছে, তা আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।
প্রায় তিন বছর প্রকৌশল বিদ্যা নিয়ে পড়ার পর ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকিতে আমি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। বিষয়টি আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও তখন প্রায় নতুন ছিল। তারপর থেকেই আজ অবধি আমি একজন ৭/২৪ মানবসম্পদ উন্নয়নকর্মী।
কেন আপনাকে বাংলাদেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়?
কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ: প্রায় ২৫ বছর ধরে আমি এবং আমার টিম এ বিষয়ে শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। কিভাবে এ সেক্টরকে আধুনিকায়ন করা যায়, সে চিন্তা-ভাবনা করছি। আমি এ কারণে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সর্বপ্রথম ১৯৯৭ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আমার হাত ধরে বেশকিছু তরুণ-তরুণী মানবসম্পদ বিষয় নিয়ে কাজ করতে শুরু করে।
> আরও পড়ুন- সবাই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখে
আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা মানুষকে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মূলধন হিসেবে বিবেচনা করে এবং তার সঠিক ব্যবহারের মধ্যেই একটি কোম্পানি অনেক গুণ মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম। একজন ভালো চাকরিপ্রার্থীকে যদি আমরা ইন্টারভিউ বোর্ডেই বিভ্রান্ত করি বা হেয় করি, তাহলে চাকরি পেলেও সে কোনভাবেই একজন প্রকৃত নিবেদিত কর্মী হবে না।
অনেক কোম্পানির মালিকপক্ষ ইন্টারভিউতে চাকরিপ্রার্থীকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। এমনকি অসম্মানসূচক মন্তব্য করেন, যদি উত্তর তার মনমত না হয়। অন্যদিকে মেধাবী এবং দক্ষ কর্মীরা বহুজাতিক কোম্পানিকে তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে রাখেন। আমি এসব চিন্তা করে অনেকদিন গবেষণা করে একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছি। যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আমার নামে প্যাটেন্টকৃত। যাকে ‘রাকিবস রিক্রুটমেন্ট রুল’ বলা হয়। আমি একমাত্র বাংলাদেশি, যাকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপরে!
এ ধরনের বেশকিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আমি গবেষণা করছি। বিশেষত আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি এবং আধুনিক মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে। তাই হয়তো বাংলাদেশে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় আমাকে। সেজন্য আমি অবশ্যই পরম করুণাময়কে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
ক্যারিয়ারের নানা দিক পার করেছেন। সেই গল্প যদি বলতেন—
কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ: কেন্টাকিতে কলেজ অব বিজনেসে অধ্যাপনার মাধ্যমে আমার চাকরি জীবন শুরু করি। এরপর পেপসি-কোলাতে শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করি। প্রায় তিন বছর পিৎজা হাটে কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টে কাজ করে নব্বই দশকের শেষে প্রায় বিশ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসি। এসে মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। আমি ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশে ট্রেনিং ম্যানেজার, ইউনিলিভার বাংলাদেশে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার, সানোফী ফার্মার হেড অব হিউম্যান রিসোর্স, প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ডিরেক্টর এইচআর, ডিবিএল গ্রুপে গ্রুপ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এইচআর, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে গ্রুপ চিফ হিউম্যান রিসোর্স অফিসার হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে কাফকোতে জেনারেল ম্যানেজার হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে দায়িত্ব পালন করছি। আমি বাংলাদেশের এইচআর কমিউনিটির শীর্ষ সংগঠন বিএসএইচআরএমের ইসি মেম্বর হিসেবেও কাজ করছি। এর সাধারণ সম্পাদকও ছিলাম একসময়। এছাড়া আমি হিউম্যান রিসোর্স সোসাইটি অব আমেরিকার একজন সদস্য। গত বছর আমেরিকায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি ২০ হাজার আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের সম্মেলনে।
> আরও পড়ুন- সহকর্মীর প্রেমে পড়লে কী করবেন?
দেশের তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ—
কাজী রাকিব উদ্দিন আহমেদ: তরুণদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে- প্রত্যেকের একটি সাহসী-সৎ স্বপ্ন থাকতে হবে। যেমন আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম একজন প্রকৌশলী হওয়ার কিন্তু আমি বর্তমানে একজন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ। তাই তরুণদের বলব, জীবনে কিছু করার ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। আমরা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বা কোন উদ্যোগের হাতেখড়ি নিতে দেখি তরুণদের এবং তাদের চিন্তা-ভাবনা সত্যিই অসাধারণ। তাই তাদের উদ্দেশে বলব, শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পেছনে পড়ে না থেকে কিভাবে নিজের মাঝে সৃজনশীলতা নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
একজন সৎ ও সাহসী মানুষের আত্মবিশ্বাস তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাফল্যমণ্ডিত ব্যক্তিদের জীবন দেখলেই জানতে পারি। তাহলে আমরা তা কেন পারবো না?
এসইউ/পিআর