বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করলেন রাইসা
শারমিন আক্তার রাইসার জন্ম ১৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। বাবা মো. আনিসুর রহমান, মা সেলিনা রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ৩৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান সরকারি কলেজে যোগদান করেন। সম্প্রতি জাগো নিউজকে তার স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ হাসান—
আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
শারমিন আক্তার রাইসা: ঢাকায় বাবার নিজস্ব ব্যবসা ছিল। ফলে ঢাকায়ই বড় হয়েছি। আমার খালু সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর উত্তরসূরি ছিলেন। তাই আমার ছোটবেলা কেটেছে সাংস্কৃতিক আবহে। ছোটবেলা থেকেই সংগীতচর্চা, খেলাধুলা, ছবি আঁকা খুব পছন্দ করতাম। দাদা বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করতেন। সে সুবাদে ছোটবেলায় আমি এবং আমার ছোট বোন বেতারে ছোটদের অনুষ্ঠানে প্রায়ই গান গাইতাম। আমার বাবা পড়ালেখা করার তেমন সুযোগ পাননি। তাই আমাদের পড়াশোনা করানোর প্রতি তার আগ্রহ ছিল অনেক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন আমরা পড়ালেখা করে একদিন অনেক বড় হবো।
পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি? স্বপ্নের মঞ্চে পৌঁছতে আপনার বিশেষ দিকগুলো—
শারমিন আক্তার রাইসা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ৩য় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান। বাবাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ফলে তার মৃত্যুর পর মায়ের জন্য পাঁচ ভাই-বোনের পড়ালেখার ব্যয়সহ পুরো সংসারের হাল ধরা অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় আমাকেও এ পর্যন্ত আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। নিজের এবং পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য টিউশন করেছি। তবুও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পড়ালেখা থেকে নিজেকে কখনো সরিয়ে রাখিনি। অনার্সে সিজিপিএ ৩.৫৯ পেয়ে ক্লাসে ৩য় স্থান এবং মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৭৫ পেয়ে ২য় স্থান অর্জন করি। ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হওয়ার সুবাদে ডিপার্টমেন্ট থেকে বৃত্তি পেয়েছিলাম, যা আমার জন্য ছিল অনেক বড় একটি অনুপ্রেরণা।
> আরও পড়ুন- সব বাধা পেরিয়ে বিসিএস ক্যাডার মনিষা
বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
শারমিন আক্তার রাইসা: আমাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমার বাবা। বাবার ব্যবসার সুবাদে অনেক সচিবদের সাথেই তার পরিচয় ছিল। তখন থেকেই তিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় একদিন বাবা আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সত্যিকার অর্থে তখন আমার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। সেদিন প্রথমবার বাবা বলেছিলেন, ‘আমি চাই তুমি বিসিএস ক্যাডার হও। মানুষ যেন আমাকে দেখে বলে, ইনি হলেন একজন বিসিএস ক্যাডারের বাবা।’
বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
শারমিন আক্তার রাইসা: যেদিন প্রথম বাবার মুখে আমাকে নিয়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নের কথা শুনি; সেদিন থেকেই আমার বিসিএস যাত্রা শুরু। একজন হোম টিউটরের কাছ থেকে বিসিএস ক্যাডার কীভাবে হয়, সে সম্পর্কে জানি। তিনি বলেন, আমি যদি বিসিএস ক্যাডার হতে চাই—প্রথমে আমাকে ইন্টারে একটি ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হন। সেই থেকে টার্গেট নিয়ে পড়াশোনা করি। যথারীতি ইন্টারে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৯০ পাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হই। অনার্সের শেষ বর্ষ থেকে ডিপার্টমেন্টের সহপাঠীরা মিলে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। বিসিএসের পুরো সিলেবাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে টার্গেট নিয়ে অনুশীলন করি। নিজেদের উদ্যোগে সাপ্তাহিক পরীক্ষা দিয়ে সেল্ফ এসেসমেন্ট করি। যেটা সত্যিই অনেক কাজে দিয়েছিল। ৩৫তম বিসিএস ছিল আমার প্রথম বিসিএস। সেবার সর্বকালের কঠিন প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে টিকে যাই। কিন্তু রিটেনে অকৃতকার্য হই। তবুও আশা ছাড়িনি। ৩৫তম বিসিএসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ৩৬তম বিসিএসে অংশ নিয়ে প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইভা পাড়ি দিয়ে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই।
বর্তমানে কোথায় কর্মরত আছেন?
শারমিন আক্তার রাইসা: ৩৬তম বিসিএসে (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান সরকারি কলেজে যোগদান করি। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) সংযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছি।
> আরও পড়ুন- ফেল করেও বিসিএস ক্যাডার!
শিক্ষা ক্যাডারে যারা আসতে চান তাদের জন্য পরামর্শ—
শারমিন আক্তার রাইসা: তাদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ হলো শিক্ষা ক্যাডার সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এবং এ ক্যাডারে সম্ভাবনার দিকগুলো ধারণ করুন। দ্বিতীয়ত, আপনি যে ক্যাডারেই আসতে চান না কেন, আপনাকে মাথায় রাখতে হবে বিসিএস হলো একটি ধৈর্যের নাম। পরিশ্রম, মেধা এবং ভাগ্যের সমন্বয়েই একজন বিসিএস ক্যাডার হয়ে ওঠেন। তাই আপনি যে ব্যাকগ্রাউন্ডেরই হোন না কেন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখুন। ৩৫তম বিসিএস থেকে যেহেতু বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নধারা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই বলছি, নিজের বেসিকের উপর জোর দিন। ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান বেশি বেশি প্র্যাকটিস করুন। অনার্সে নিজ অধীত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করুন। দৈনিক বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা, টেলিভিশন নিউজ কিংবা ফেসবুক বিসিএস গ্রুপগুলো থেকে সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে জানুন। যা জানবেন, বিস্তারিত জানার চেষ্টা করুন। কেননা বিসিএসে শর্টকার্টের দিন শেষ। অবশ্যই প্রতিদিন রুটিন করে এবং টার্গেট নিয়ে স্টাডি করুন। এক্ষেত্রে গ্রুপ ডিসকাশনও অনেক কাজে দেবে। তাই একটি গ্রুপ করে টার্গেট নিয়ে স্টাডি করুন। আপনার পরিচিত বিসিএস ক্যাডারদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। কেননা তাদের অভিজ্ঞতাও আপনাকে টার্গেট সেট করতে সহায়তা করবে। নিয়মিত স্পোকেন ইংলিশ প্র্যাকটিস করুন। সর্বশেষ বলবো, বেশি বেশি স্বপ্ন দেখুন যে, স্বপ্ন আপনাকে ঘুমাতে দেবে না, কেবল জাগিয়ে রাখবে।
কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
শারমিন আক্তার রাইসা: আমার প্রথম অনুপ্রেরণা আমার বাবা। এছাড়া আমার মা, ভাই-বোন, স্বামী, বন্ধু, শিক্ষকরাও আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শারমিন আক্তার রাইসা: স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন দেখি শিক্ষা সচিব হওয়ার। এজন্য নিজেকে আরও যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাই। ভবিষ্যতে পিএইচডি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এসইউ/এমএস