ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাগো জবস

দেশি কাপড়ে বিদেশি ছোঁয়া তানজিনার

আরিফুল ইসলাম আরমান | প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ০৩ এপ্রিল ২০১৯

তানজিনা হক একজন তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি ‘অংশু’ নিয়ে কাজ করছেন চার বছরেরও বেশি সময় ধরে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। একযুগ ধরে বিভিন্ন দেশি, বিদেশি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি চলছিল অংশুর কাজ। গত বছর থেকে পুরোপুরিভাবে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন। তার উদ্যোগ ও সফলতা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম আরমান-

কীভাবে এ উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হলেন?

তানজিনা হক: ২০১০-২০১১ সালের দিকে ফেসবুকের আনাচে-কানাচে বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, ‘আমাদের কি কিছুই নেই বিপণনযোগ্য!’ অনেক বন্ধু সেখানে আক্ষেপ জানিয়েছিল। আর একজন অফার করেছিল ইনভেস্ট করার। বলেছিল, ‘তুমিই কিছু শুরু করো না!’ নিজ থেকে কিছু করার পোকাটি হয়তো তখনই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু সাহস জোগাতে আরও বেশকিছু সময় লেগে গেল। ২০১৫ সালের প্রচণ্ড শীতার্ত এক বিকেলে অংশুর কাজ শুরু করি রংপুর শহরে। এর মাসখানেক পরেই রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স করিয়ে ফেলি।

শুরুটা কীভাবে করলেন?

তানজিনা হক: পুরোদস্তুর চাকরিজীবী পরিবারের সদস্য আমি। পড়াশোনার পর চাকরির বাইরে আরও কিছু করতে পারি, সে চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি। ২০১৪ সালে বরের চাকরিসূত্রে রংপুর শহরে যেতে হয়। সেই শহর চষে বেড়াতে বেড়াতে অদূরবর্তী একটি গ্রামের গল্প শুনতে পেয়েছিলাম। তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষে মহিপুর নামে ছিমছাম একটি গ্রাম। সেখানে গড়ে উঠেছিল তাঁতিপাড়া। সময়ের বিবর্তনে নানা প্রতিকূলতায় বেশিরভাগ তাঁতিই ধীরে ধীরে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। সেই গ্রামেরই কোনরকমে বেঁচেবর্তে থাকা এক তাঁতির সাথে আলাপ প্রসঙ্গে তাদের তাঁতশিল্পের দুরবস্থার কথা জানতে পারলাম। তার কর্মনৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে নিজের জন্য একটি শাড়ি করতে দিয়েছিলাম। এর কিছুদিন আগেই জড়িত হয়েছিলাম ‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’ (নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা একটি গ্রুপ) এর সাথে। সেখানকার কিছু সদস্য আমার শাড়ির ছবি দেখে খুব জোর আবদার করল তাদের জন্যও শাড়ি করিয়ে দিতে। তাঁতিরা শুরুতে রাজি হননি, একমাস-দু’মাস সময় লাগবে বলে পাশ কাটিয়েছেন। কিন্তু যখন দেখলেন, তাদের কাজ দেখে বার বার মুগ্ধ হচ্ছি আর ফিরে ফিরে যাচ্ছি। তখন তারা নিজ থেকেই ব্যবসা শুরু করার ব্যাপারে সায় দিলেন। ব্যস, এভাবেই অংশুর শুরু।

tanjina

কোন প্রতিবন্ধকতা এসেছে কি-না?

তানজিনা হক: অনলাইন ব্যবসায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ক্রেতাদের আস্থাভাজন হতে পারা। শুধু ছবি দেখে কোন পণ্যের ব্যাপারে ডিসিশন নেওয়াটা একটু রিস্কি হয়ে যায়। এ পন্থায় অনেক সময় অনেক ক্রেতা প্রতারিতও হয়েছেন। আমাকে তাই শুরু থেকেই ক্রেতাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়েছে। যে কোন ব্যবসায় কাস্টমার সার্ভিস খুব বড় একটি ভূমিকা পালন করে। আমি বরাবরই পণ্যের মান এবং কাস্টমার সার্ভিস- এ দুটো বিষয়ে লক্ষ্য রেখেছি। আমি চেষ্টা করেছি, ক্রেতাদের বন্ধু হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করতে। এভাবেই একজন, দু’জন করে মুখেমুখে অংশুর কথা অনেক জনের কাছে পৌঁছে গেছে।

তবে আমাদের তাঁতিদের প্রফেশনালিজমের বেশ অভাব রয়েছে এখনো। সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারাটা এজন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য সেজন্য কোন অর্ডার নেওয়ার আগে আমি ক্রেতাদের জানিয়ে রাখি, কতটুকু সময় লাগতে পারে।

এছাড়া উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থাও সহনশীল নয় একেবারেই। অনলাইন ব্যবসাটি এখনো অনেক সরকারি অফিসই বুঝতে পারে না বা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় না। যেমন ধরুন, আমাদের কাছে প্রচুর অর্ডার আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিদেশে পণ্য পাঠানোর প্রধান অবলম্বন ছিল বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের ইএমএস সার্ভিস। সময় কিছু বেশি লাগলেও খরচ অনেকটাই সহনশীল ছিল। এবারের বাজেটের পরে ইএমএস চার্জ হুট করে তিনগুণ বেড়ে গেল। আর অফিসিয়াল কাজের জন্য স্পিড মানি চাওয়ার কালচার তো বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট, সচেতন, কার্যকরী পদক্ষেপই সুষ্ঠু সমাধান বয়ে আনতে পারে।

tanjina

কীভাবে এগিয়ে গেলেন? সফলতা-ব্যর্থতার কথা যদি বলেন-

তানজিনা হক: অংশুকে ব্যবসা না বলে দেশি শিল্পের প্রদর্শনীর মাধ্যম বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব। শুধু কেনা-বেচাই নয়, প্রতিটি পণ্য যেন একেকটি গল্প হয়ে কারও জীবনে ঠাঁই করে নিতে পারে। প্রতিটি শাড়িতে যেন লেখা থাকে অসংখ্য দিবারাত্রির গল্প; এটাই অংশুর প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশি তাঁতি বা আর্টিসানদের কাজে দক্ষতা বা নৈপুণ্যের কোন অভাব নেই। নয়তো কি পোশাকশিল্পে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে থাকি! তবে আমরাও যে পারি, এ আত্মবিশ্বাসটুকু ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে থাকতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, আমাদের এই ছোট ছোট উদ্যোগ আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। আমি শুরু করেছিলাম দেশি কাতান, জামদানি শাড়ি নিয়ে। নানা রং আর ডিজাইন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। প্রতিবারই নতুন কিছু করার আগে অংশুর অনুরাগীদের (ক্রেতাদের) মতামত নিয়েছি। তাদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন সব পণ্য যোগ করেছি। দেশি ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশে ফিউশন প্রোডাক্ট নিয়েও ভাবনা ছিল অনেক দিনের। গত বছর ঈদ উপলক্ষে আমাদের ফিউশনধর্মী প্রোডাক্ট লাইন ‘Angshu Attire’ যাত্রা শুরু করে। আমাদের ডিজাইনের মূল ভাবনা ছিল দেশি কাপড়ে বিদেশি ডিজাইন। সে লক্ষ্যে আমরা কাতান কাপড়ে ডিজাইন করেছি মারমেইড স্কার্ট, ভিক্টোরিয়ান ব্লাউজ, সামার ড্রেস ইত্যাদি।

প্রচারণার ক্ষেত্রে কী করছেন?

তানজিনা হক: যেমনটা আগে বলেছি, অনলাইনে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে বিশ্বাস তৈরি করতে পারাটা খুব বড় একটি ব্যাপার। সেক্ষেত্রে ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’ খুব জরুরি বিষয়। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে প্রত্যেক ক্রেতার চাহিদা বুঝে সে অনুযায়ী পণ্যসেবার ব্যবস্থা করার। সেই সাথে এফ-কমার্সের টুলসগুলোর ব্যাপারে ধারণা রাখতে চেষ্টা করি। ‘মেয়ে’ গ্রুপ থেকে আয়োজিত মেলাতে অংশগ্রহণও ক্রেতাদের কাছাকাছি আসার বড় একটি সুযোগ।

tanjina

ভবিষ্যতে আপনার প্রতিষ্ঠানকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?

তানজিনা হক: দেশি পণ্যের প্রতি সবার ভালোবাসা বেড়ে উঠুক- এ প্রত্যয় নিয়েই শুরু করেছিলাম অংশু। আশা করি তাতে কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। শুধু নারী উদ্যোক্তা নয়, বাংলাদেশি হিসেবে আমার একমাত্র ভাবনা- বিশ্বে আমার দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সেই সাথে দেশি পণ্যের প্রতি আমাদের নিজেদের ভালোবাসা, নির্ভরতা বাড়িয়ে তোলা। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে এসেছে বলেই আমাদের পোশাকশিল্প আজ উন্নতির শিখরে। অন্যান্য সেক্টরেও নারীর দৃপ্ত পদচারণা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেই অগ্ৰগতিরই ছোট একটি অংশ হিসেবে আমি নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।

এসইউ/এমকেএইচ

আরও পড়ুন