চ্যালেঞ্জকে কখনোই চাপ মনে হয়নি : রাশেদুজ্জামান
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান মবিল বাংলাদেশের উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। দীর্ঘ ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এনার্জিপ্যাকের মাধ্যমে। বুয়েট থেকে যন্ত্রকৌশলের ওপর গ্রাজুয়েশন করেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদ এবং আইবিএ থেকে মার্কেটিংয়ের ওপর আলাদাভাবে দুইবার এমবিএ করেন। তার ক্যারিয়ারের নানা দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কর্পোরেট আস্কের সিইও নিয়াজ আহমেদ-
জাগো নিউজ : ক্যারিয়ারের শুরুতে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : ‘ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও কেন বিক্রয় পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাই?’- প্রশ্নটিই ছিল আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ‘একজন বিক্রয়শিল্পীর কোনো অফিস থাকতে পারে না। তাকে মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়াতে হবে, সেলস টার্গেট সম্পূর্ণ করার জন্য।’ অফিসের বস যখন প্রথমবার আমাকে কথাগুলো বলেছিলেন, তখন বিক্রয় পেশাটাকে আসলেই খুব চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল। ক্যারিয়ারের শুরুতে নির্দিষ্ট সেলস টার্গেট পুরা করার জন্য দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ানোকেই একসময় অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিলাম। পাশাপাশি মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই- যে করেই হোক, আমাকে বিক্রয় পেশায়-ই সফল হতে হবে। আমি ছাত্র জীবন থেকে নিজেকে প্রতিটি বিষয়ে টার্গেট দিতাম। টার্গেট অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করতাম। বিক্রয় পেশায় সফল হতে হলে শুধু পণ্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই হয় না, থাকতে হয় সহনশীলতা এবং ধৈর্য। যে কোনো উপায়ে কোম্পানির নিয়মের মধ্য থেকে কাস্টমারকে বুঝিয়ে কাজ আদায় করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু অনেক আগে থেকেই আমি টার্গেট অনুযায়ী পরিকল্পনা করি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করি, কাজেই চ্যালেঞ্জটাকে আমার কাছে কখনোই চাপ বলে মনে হয়নি।
জাগো নিউজ : একজন বিক্রয়শিল্পীর কী কী গুণাবলী থাকা উচিত?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : একজন বিক্রয়শিল্পীকে নিত্যনতুন সম্ভাবনা খুঁজে বের করার মতো দূরদর্শী হতে হবে। ইতিবাচক মানসিকতা আর উদ্যমী মনোভাব একজন বিক্রয়শিল্পীর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। একজন বিক্রয়কর্মীর মাঝে সততা, সময়ানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম করার মনোভাব থাকতে হবে। স্কুলে লেখাপড়া করার সময় গণিত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। বিক্রি অনেকটা গণিতের মতো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য টার্গেট সম্পন্ন করার মাধ্যমে খুব সহজেই একজন বিক্রয়শিল্পীর দক্ষতা পরিমাপ করা সম্ভব। সে জন্য প্রতিদিনের লিখিত পরিকল্পনা ও বিগত কাজগুলোর নিজস্ব মূল্যায়ন থাকা বাঞ্ছনীয়।
জাগো নিউজ : আপনার কাছে সফলতার অর্থ কী?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : ক্যারিয়ারে সফলতার মানে হচ্ছে- আপনার উপর অর্পিত দায়িত্বটা কোম্পানির নিয়ম মেনে যথাসময়ে সম্পন্ন করা। এছাড়াও সফল হতে হলে সুস্বাস্থ্যের কোনো বিকল্প নেই। কর্পোরেট দুনিয়ায় সফল হতে গিয়ে একেবারে রোবট হয়ে যাওয়াটা আবার আমি সমর্থন করি না। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স করে চলতে হবে।
জাগো নিউজ : তরুদের ঢাকার বাইরে চাকরি করতে অনীহার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : প্রকৃতপক্ষে কাজ শিখতে হলে ঢাকার বাইরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা, তাদের আচার-আচরণ এবং চাহিদাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, কোম্পানির পণ্য বা সেবা তাদের কাছে যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়া, ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ দেওয়া, প্রতিযোগী কোম্পানির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা, নতুন পণ্য বা সেবার ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা চালানো এবং সব ধরনের প্রয়োজনীয় রিপোর্ট তৈরি করাসহ প্রত্যেকটি কাজ সম্পর্কে চমৎকারভাবে ধারণা পাওয়া যায়। আজ যারা কর্পোরেটে সফল ব্যক্তিত্ব, নতুন নতুন বিজনেস প্ল্যান দিচ্ছেন, তাদের কেউই কেবল ঢাকায় কাজ করে আজকের অবস্থানে যাননি। সবাই মাঠ থেকে উঠে এসেছেন।
জাগো নিউজ : বিক্রয় পেশায় নারীদের কম অংশগ্রহণের কী কী কারণ আছে?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : আমাদের সমাজ এখনো পুরুষ শাসিত। এখানে নারীদের পক্ষে বাইরে গিয়ে কাজ করাটা পরিবারের অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধসহ সব দিক বিবেচনায় নারীরা এখনো পিছিয়ে। তবে যে সব নারী এ প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের আসলে কোনো বাধাই দাবিয়ে রাখতে পারে না।
জাগো নিউজ : এক বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্য পেশায় যাওয়ার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কেমন?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : এ ক্ষেত্রে আমি বলবো, এটা তাদের দূরদর্শিতার অভাব, পরিকল্পনার অভাব। যেটা হতেই চাই না, সেটা পড়েই বা কী লাভ? বিক্রয় ও বিপণনের ওপর জ্ঞান লাভ করে হিসাবরক্ষণে কাজ করতে হলে, তার চেয়ে হিসাববিজ্ঞান পড়েই হিসাবরক্ষণে যাওয়া ভালো। জীবনের শুরুতে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আমি বলবো, এই লক্ষ্য কলেজ লাইফ থেকেই হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্য বরাবর ফোকাস থাকতে হবে। এইম ইন লাইফ এবং এইম ইন ক্যারিয়ারের পার্থক্যটা নিজে থেকে বোঝা উচিত।
জাগো নিউজ : সেলস এবং মার্কেটিংয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : সেলস হচ্ছে- আগে ক্লায়েন্টের কাছে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দেওয়া। ধীরে ধীরে পণ্য বা সেবা ব্যবহার করার মাধ্যমে ভোক্তা সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। অপরদিকে মার্কেটিং হচ্ছে- প্রস্তাব করা, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে ভোক্তাকে জানানো, বোঝানো। ভোক্তা যখন পণ্য বা সেবার মান ও অন্যান্য দিক জানবে, তখন সে তার পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেবে। আগে মার্কেটিং, পরে হচ্ছে সেলস।
জাগো নিউজ : বিক্রয় পেশা থেকে সফলতার শেষ ধাপ কোনটি?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : সবাই সফল হবেন না, এটা মেনে নিতে হবে। পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে বেশি বেতন পান, যারা অপরকে দিয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারেন। অর্থাৎ ক্যারিয়ারে সে-ই এগিয়ে যাবে, যার আছে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা। যার কাছে আছে সমস্যার সমাধান। মানুষ তাকেই খোঁজে, যিনি কোম্পানির হাল ধরতে পারেন। যাকে বিশ্বাস করা যায়, যাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। যে কোনো বিভাগ থেকেই আসা হোক না কেন, এই সাধারণ দিকগুলো খেয়াল রাখলে যে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই ক্যারিয়ারের উচ্চ শিখরে পৌঁছানো সম্ভব। একজন বিক্রয়শিল্পী ভোক্তার সাথে কাজ করেন। কার কী দরকার, সে কী চায়, অন্যরা কী দেয়, কী পেলে তার জন্য আরো ভালো? এসবের খবর কেবল একজন বিক্রয়শিল্পীর কাছেই থাকে। কোম্পানির ব্যবসার ধরন অনুযায়ী কোম্পানির অধীনস্ত ডিপার্টমেন্টগুলোর গুরুত্ব নির্ভর করে। তাহলে সেলস ড্রিভেন একটি কোম্পানির প্রধান বিক্রয় বিভাগ থেকে উঠে আসলেই কোম্পানির ব্যবসার উন্নয়ন ঘটবে।
জাগো নিউজ : ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের সময় কোন কোন দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : শুরু থেকেই একজন মানুষ যদি তার শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ এবং বাধাগুলো সম্পর্কে জানে, তাহলে সে চমৎকারভাবে প্ল্যান করতে পারবে। প্যাশনটা আগে ভালো করে বুঝতে হবে। যে কাজটা ভালো লাগে, তার বাজারদর কেমন, তার ভবিষ্যৎ কী- তা আপনাকে জানতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যের দেওয়া লক্ষ্য বরাবর চলতে চেষ্টা করার চেয়ে বড় বোকামি আর কিছুই নেই।
জাগো নিউজ : বিক্রয় পেশার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন আছে কি?
মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান : প্রধান তিনটি ট্রেনিং থাকা অত্যাবশ্যক- মাইক্রোসফট অফিস প্যাকেজ, বিক্রয় পেশার ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজি শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারার দক্ষতা। এরপর কারো যদি কমিউনিকেশন স্কিল জানতে হয়, প্রেজেন্টশনের ওপর, সেলসের ওপর আরো ট্রেনিং লাগে- সে সেটা করতে পারে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। নিয়মিত পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন আজীবন বাকি সবার চেয়ে আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
এসইউ/জেআইএম