প্রিগোজিন থেকে নাভালনি
পুতিনের সমালোচনা করে ‘রহস্যময় মৃত্যু’ হয়েছে যাদের
রাশিয়ার বিরোধী নেতা ও ক্রেমলিনের কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনি গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) মারা গেছেন। আর্কটিক সার্কেল জেলে বন্দি অবস্থায় ‘রহস্যময়’ মৃত্যু হয়েছে তার। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের ‘রহস্যজনকভাবে’ মৃত্যুবরণ করার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। রীতিমতো তালিকা করা যাবে এমন মানুষদের। কখনো প্লেন দুর্ঘটনা, কখনো জানালা দিয়ে পড়ে যাওয়া, কখনো বিষপ্রয়োগ, কখনো হয়তো গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু হয়েছে পুতিনের সমালোচনাকারীদের। তাদের তথাকথিত ‘দুর্ঘটনাজনিত’ বা ‘আত্মহত্যা’র মাধ্যমে মৃত্যুগুলো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে আজও।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু ঘটনা-
ইভজেনি প্রিগোজিন
রাশিয়ার আধা-সামরিক বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের সাবেক প্রধান প্রিগোজিন একসময় দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং পুতিনের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন। ২০২৩ সালে মাঝআকাশে প্লেন বিস্ফোরিত হয়ে মারা যান তিনি। উল্লেখ্য যে, ইউক্রেন যুদ্ধের দিকনির্দেশনা নিয়ে মতবিরোধের জেরে মস্কোর বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘটনার মাত্র দুই মাস পরেই প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যান প্রিগোজিন।
আরও পড়ুন>>
- বিদ্রোহ করেছে ওয়াগনার গ্রুপ, পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি
- প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোজিন নিহত
- পুতিনের বাবুর্চি থেকে বিদ্রোহের নেতা, কে এই প্রিগোজিন?
বরিস নেমতসভ
১৯৯০র দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিস নেমতসভ। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রেমলিনের কাছাকাছি একটি সেতুর ওপর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। এর আগে, পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়েছিল নেমতসভকে। তাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি ক্রিমিয়া দখলের পর ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি সমাবেশ আয়োজনে সাহায্য করছিলেন।
বরিস বেরেজভস্কি
বেরেজভস্কি ছিলেন একজন প্রভাবশালী রুশ ব্যবসায়ী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তার ধনসম্পদ হু হু করে বাড়তে থাকে। বেরেজভস্কির সম্পদের একটি বড় অংশ এসেছিল বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি থেকে। কিন্তু রুশ মিডিয়ায় বিনিয়োগের পর তার সম্পদ এবং রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই আকাশচুম্বী হয়।
তবে পরবর্তীতে পুতিনের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান বেরেজভস্কি। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় বাথরুমের মেঝের ওপর বেরেজভস্কির মরদেহ খুঁজে পায় পুলিশ। তারা বলেছিল, বেরেজভস্কির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই এবং তিনি নিজেই নিজের জীবন নিয়েছেন।
আরও পড়ুন>>
আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো
লিটভিনেঙ্কো ছিলেন একজন সাবেক রুশ গুপ্তচর, যিনি পরে ক্রেমলিনের সমালোচক হয়ে ওঠেন। যুক্তরাজ্যের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে লন্ডনের একটি হোটেল বারে লিটভিনেঙ্কোকে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন রাশিয়ার দুজন এজেন্ট। তারা লিটভিনেঙ্কোর গ্রিন টি’র ভেতর অত্যন্ত বিষাক্ত পোলোনিয়াম-২১০ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এর কয়েকদিন পরেই মারা যান লিটভিনেঙ্কো। অভিযোগ রয়েছে, তার সঙ্গে যা ঘটেছিল এর জন্য পুতিন এবং ক্রেমলিনই দায়ী।
রাভিল ম্যাগানভ
রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী লুকোইলের বোর্ড চেয়ারম্যান রাভিল ম্যাগানভ প্রকাশ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের সমালোচনা করেছিলেন। তার ঠিক ছয় মাস পরেই মস্কোর একটি হাসপাতালের জানালা থেকে পড়ে মারা যান তিনি। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস তার মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করেছিল।
আনা পলিটকভস্কায়া
পলিটকভস্কায়া ছিলেন চেচনিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধের একজন সোচ্চার সমালোচক। ২০০৬ সালে মস্কোয় নিজের অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশপথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পলিটকভস্কায়ার মৃত্যু আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আট বছর পরে ২০১৪ সালে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে পাঁচজনকে শাস্তি দেওয়া হয়। তবে হত্যার নির্দেশ কে দিয়েছিলেন তা আজও জানা যায়নি।
আরও পড়ুন>>
- ২০২৪ সালের নির্বাচনেও অংশ নেবেন পুতিন, নেই হারের শঙ্কা
- রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৬ বছরে পুতিনের আয় মাত্র ৮ কোটি টাকা!
- পুতিনের গুপ্তচর থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা যেভাবে
সের্গেই ম্যাগনিটস্কি
ম্যাগনিটস্কি ছিলেন রাশিয়ার একজন ট্যাক্স উপদেষ্টা। সরকারের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের পর তাকে বিনাবিচারে বন্দি রাখা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার ঠিক সাত দিন আগে কারাগারে মারা যান ম্যাগনিটস্কি। তাকে গ্রেফতার করা হয় ২০০৮ সালে এবং তিনি মারা যান ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর।
আলেকজান্ডার পেরেপিলিচনি
পেরেপিলিচনি ছিলেন একজন অর্থদাতা, যিনি ২০১০ সালে হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে আবির্ভূত হন এবং রাশিয়ার কোষাগার থেকে ২৩ কোটি মার্কিন ডলার চুরি যাওয়ার নথি সুইস কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন। ২০০৯ সালে রাশিয়া ছাড়েন পেরেপিলিচনি। ২০১২ সালে লন্ডনের কাছাকাছি একটি জায়গায় জগিং করার সময় মারা যান তিনি। যদিও তিনি প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবে অভিযোগ রয়েছে, তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
ওপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও গত এক বছরে অন্তত ১৩ জন হাই-প্রোফাইল রুশ ব্যবসায়ী আত্মহত্যা বা রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র: সিএনএন, এনডিটিভি
কেএএ/