হামাসের রহস্যময় সামরিক প্রধানকে খুঁজে হয়রান ইসরায়েল
ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে ও ইসরায়েলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের ফেরারি সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম সবার উপরে।
বলা হচ্ছে মোহাম্মদ দেইফের কথা, হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার তিনি। দেইফকে হত্যার জন্য ইসরায়েল হন্যে হয়ে খুঁজছে। বছরের পর বছর ধরে বহু চেষ্টা চালিয়ে তাকে কোনোভাবেই ধরতে পারছে না ইসরায়েল।
২০২১ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে লড়াই চলাকালে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করে ইসরায়েল, কিন্তু তাকে হত্যা করা যায়নি। তখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই যিলবারম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
আইডিএফের কর্মকর্তারা ২০২১ সালে বিবিসির কাছে স্বীকার করেন যে, মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য অন্তত দুটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ইসরায়েলিদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, মোহাম্মদ দেইফ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলা হচ্ছে, গত দুই দশকে ইসরায়েল এ নিয়ে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য সাতবার বিফল চেষ্টা চালিয়েছে।
মোহাম্মদ দেইফকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হতাশ। ২০২১ সালে লড়াইয়ের সময়েও তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের সব শীর্ষ সামরিক অধিনায়ককে হত্যা করা।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ম্যাথিউ লেভিট বলেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, হামাসের সামরিক সক্ষমতার পেছনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের একটা তালিকা ইসরায়েলের কাছে আছে ও এই তালিকায় সবার উপরে আছেন মোহাম্মদ দেইফ।
‘গাজার অতিথি’
মোহাম্মদ দেইফ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি অভিনয় ও থিয়েটারের প্রতি আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন, আর সেখানে তিনি একটি শিল্পী দল গঠন করেছিলেন।
যখন হামাস প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়, তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেফতার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কারাভোগ করেন।
মোহাম্মদ দেইফ সম্পর্কে যা জানা যায়, তা মূলত ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, মোহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬৫ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন মিশরের দখলে।
জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। কিন্তু ইসরায়েলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবন-যাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘দেইফ’ নামে, আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি।’
বহু দশক ধরে চলতে থাকা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম।
হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেইফ একজন তরুণ। ১৯৮০’র দশকের শেষে তিনি হামাসে যোগ দেন। হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডে’ মোহাম্মদ দেইফ বেশ দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকেন ও বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী উপদেষ্টা ম্যাথিউ লেভিট বলেন, দেইফকে বেশ কট্টরপন্থী হামাস কর্মকর্তা বলেই মনে করা হয়। তিনি হামাসের খুব কট্টরপন্থী কিছু অধিনায়কের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন ইয়েহিয়া আইয়াশ, যিনি ছিলেন বেশ দক্ষ একজন বোমা প্রস্তুতকারক। আইয়াশকে লোকে চিনতো ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ইসরায়েলে যাত্রীবাহী বাসে বোমা হামলার জন্য আইয়াশকে দায়ী করা হয়। ১৯৯৬ সালে ইসরায়েল তাকে হত্যা করে। কিন্তু এর ঠিক পরেই ইসরায়েলে বাসে আরও অনেক বোমা হামলা হয়। মোহাম্মদ দেইফ ছিলেন আইয়াশের শিষ্য। অভিযোগ ওঠে, প্রতিশোধ হিসেবে তিনিই এসব হামলা পরিচালনা করেছিলেন।
প্রযুক্তি নিয়ে জ্ঞান
দেইফ গাজা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন ও একইসঙ্গে বড় সংখ্যক রকেট উৎক্ষেপণের কৌশল জানা হামাস সদস্যদের একজন ছিলেন।
১৯৯৬ সালের পর মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ২০০২ সালে হামাসের সামরিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দীন শেহাদেহকে হত্যার পর নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন দেইফ।
হামাসের যে বিখ্যাত ‘কাসাম রকেট’, সেটির পরিকল্পনা ও তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় দেইফকে। গাজার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও নাকি তার পরিকল্পনাতেই করা হয়েছে। তিনি নাকি দিনের বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যেই কাটান। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
প্রাণে বেঁচে গেছেন বহুবার
ইসরায়েলি নজরদারিকে ফাঁকি দেয়ার ওপরই নির্ভর করে মোহাম্মদ দেইফের জীবন। তাকে হত্যা করার সবচেয়ে জোরালো প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০০২ সালে, যেটা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নিজের একটি চোখ হারান তিনি।
ইসরায়েলের তথ্যমতে, তিনি তার একটি পা এবং একটি হাতও হারিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার পর বেঁচে থাকলেও তার কথা বলতে অসুবিধা হয়।
এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় তিনি আহত হলেও পালাতে সক্ষম হন। ইসরায়েলি প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, শরীরের কয়েকটি অঙ্গ উড়ে গেছে। ২০০৬ সালে ইসরায়েলের হামলায় মোহাম্মদ দেইফ যে গুরুতর আহত হয়েছেন সেটা নিশ্চিত করেছেন আইডিএফের এক সাবেক গোয়েন্দা প্রধান।
তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, লোকে ভেবেছিল মোহাম্মদ দেইফ আর নেতা হিসেবে বা একজন সামরিক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি সেরে ওঠেন। ইসরায়েলের এসব হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ দেইফের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তাকে তার শত্রুপক্ষ বর্ণনা করতে থাকে ‘নয়বারের জীবন পাওয়া বিড়াল’ বলে।
২০১৪ সালে গাযায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সময় তার ওপর পঞ্চম হামলাটি চালানো হয়। গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকার একটি বাড়িতে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় মোহাম্মদ দেইফের স্ত্রী উইদাদ ও তাদের শিশুপুত্র আলি নিহত হয়। ইসরায়েলিরা ভেবেছিল, তারা মোহাম্মদ দেইফকেও হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু তিনি আসলে তখন সেই বাড়িতে ছিলেন না।
এই হামলার পরপরই হামাস জানিয়েছিল, মোহাম্মদ দেইফ এখনো বেঁচে আছেন ও তিনিই হামাসের সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহাম্মদ দেইফ যে বারবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারছেন তার কারণ তিনি আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার একেবারেই এড়িয়ে চলেন।
লেভিট বলেন, আপনি যদি মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটার ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনি কোথায় আছেন, সেই ধারণা পাওয়া আধুনিক গুপ্তচর সংস্থাগুলোর জন্য খুব কঠিন হবে।
আর ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান বলছেন, মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা যে ব্যর্থ হচ্ছে তার অনেক কারণ আছে। হামাসের টানেলগুলো যেরকম গভীর ও বিস্তৃত এবং দেইফের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য এতই পুরনো যে, তার বর্তমান অবস্থান খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া কিছু অভিযানে আমাদের অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করেনি।
সূত্র: বিবিসি
এসএএইচ