ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

কেন স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করে আসছেন শিখরা?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:০৯ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছে কানাডা। এই ঘটনার পর থেকেই ভারতে শিখদের জন্য ‘খালিস্তান’ নামে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

গত জুন মাসে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ভারত জড়িত থাকতে পারে বলে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তোলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তার এই অভিযোগের পর ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।

আরও পড়ুন: ভারত-কানাডা দ্বন্দ্বে কার পক্ষ নেবে যুক্তরাষ্ট্র? 

ভারত অবশ্য এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে একে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে।

শিখ কারা এবং তারা কোথায় বাস করেন?
শিখ ধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মগুলোর একটি। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের ভূখণ্ডের মধ্যে ভাগ হয়ে থাকা পাঞ্জাবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো ষোড়শ শতকে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পাঞ্জাবকে দুভাগে ভাগ করা হয়।

বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় আড়াই কোটি শিখ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন এবং ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। এদের বড় অংশই বাস করেন ভারতে। দেশটির মোট জনসংখ্যার আড়াই শতাংশ এখন শিখ। আবার শিখদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অভিবাসীও হয়েছেন।

ভারতের বাইরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিখ বাস করে কানাডায়, যার সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এটি কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে আরও প্রায় পাঁচ লাখ। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন প্রায় দুই লাখ শিখ ধর্মাবলম্বী।

শিখরা আলাদা রাষ্ট্র চাইছেন কেন?
ভারতের শিখদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নাম খালিস্তান মুভমেন্ট বা খালিস্তান আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল, ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের পাঞ্জাবে ১৯৮০’র দশকে এই আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। এর জের ধরে তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত্যু হয় হাজারো মানুষের।

কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানের পর এই আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ওই আন্দোলনের পর আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতির গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রুতি কাপিলা বলেন, এখন আর স্বাধীনতা আন্দোলন সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখদের অবস্থান নয়। তার মতে, আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতি খালিস্তান আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছে। আর স্বাধীন রাষ্ট্র বর্তমানে বেশির ভাগ শিখের চাওয়া-পাওয়া নয় বলেও রাজনীতিবিদেরা দাবি করছেন।

তবে বিদেশে অভিবাসী শিখদের একটি অংশ আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে তাদের প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে এবং গত কয়েক বছরে তা বেশ জোরদার হয়েছে। তারা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জোরদার হয়েছে।

এই আন্দোলন ভারত সরকারের জন্য স্পর্শকাতর
ভারত শুরু থেকেই শক্তভাবে খালিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছে। মূলধারার সব রাজনৈতিক দল এমনকি পাঞ্জাবের দলগুলোও সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধিতা করেছে। তবে এই দীর্ঘ উত্তেজনার জের ধরে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের দুটি সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার জন্ম হয়েছে।

এর একটি হলো অমৃতসর স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান এবং অন্যটি হলো ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। ১৯৮৪ সালের জুনে শিখদের পবিত্রস্থান স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সেখানে আশ্রয় নেওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উচ্ছেদ করা হয়।

এর জের ধরে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডের খবর সামনে আসে। বড় ধরণের ক্ষতি হয় স্বর্ণ মন্দিরের। এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ওই অভিযানের কয়েকমাস পর নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। এই ঘটনার জের ধরে টানা চার দিন দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয় ভারতে।

আরও পড়ুন: ভারতীয় অভিবাসীদের ওপর কি আদৌ কানাডা-ভারত দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়বে?

এতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়, যার বেশিরভাগই শিখ। এ সংখ্যা তিন হাজার থেকে ১৭ হাজার পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। ভারতের সব রাজনৈতিক দলই শিখ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে। যে কারণে দেশটির কোনো সরকারই খালিস্তান ইস্যুকে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ইস্যু বানাতে রাজি হয়নি।

হরদীপ সিং নিজ্জার কে?
কানাডার নাগরিক ৪৫ বছর বয়সী হরদীপ সিং নিজ্জারকে গত ১৯ জুন কানাডার একটি শিখ মন্দিরের বাইরে পার্কিং লটে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার জন্ম হয়েছিল পাঞ্জাবের জলন্ধরের ভারসিংপুর গ্রামে। তবে বহু বছর তিনি ভারতে আসেননি। কয়েক বছর আগে তার জলন্ধরের সম্পত্তিও ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

হরদীপ সিং নিজ্জার ভারত সরকারের কাছে একজন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। তিনি খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ বা কানাডাতে ‘শিখস ফর জাস্টিসে’র (এসএফজে) মতো একাধিক সংগঠনেরও প্রধান ছিলেন। তবে তার সমর্থকরা এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে আসছেন এবং বলছেন তিনি অতীতেও বহুবার হুমকির শিকার হয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম অবশ্য বলছে তিনি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবিতে একটি গণভোট আয়োজনের জন্য কাজ করছিলেন।

অভিবাসী শিখদের ওপর ভারতের চাপ
ভারতকে ঘিরে কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণ হলো দেশটি তিনটি সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছিল। এই তিনটি দেশ হলো কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। ভারত সরকার প্রকাশ্যেই বলে আসছে যে, ‘শিখ চরমপন্থা’ মোকাবিলায় ব্যর্থতাই ভালো সম্পর্ক গড়ার পথে বাধা।

অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, খালিস্তানপন্থিদের হাতে হিন্দু মন্দির ভাংচুরের ঘটনা তারা তদন্ত করবে। কিন্তু তারা সে দেশের শিখদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হবে না। খালিস্তানপন্থিদের আন্দোলনের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্যও কানাডার সমালোচনা করে আসছে ভারত।

কানাডায় ট্রুডোর সরকার গঠনে শিখদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিখরা কানাডার রাজনীতিতেও যথেষ্ট সক্রিয়। কানাডার হাউজ অব কমন্‌সে ১৮ জন শিখ সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাই ট্রুডো বা কানাডার কোনো রাজনৈতিক দলই শিখদের চটাতে চান না।

কানাডার মাটিতে খালিস্তানপন্থি শিখ আন্দোলনকারী হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে হত্যা করা হয় গত জুন মাসে। তিনি ছিলেন খালিস্তানপন্থি সংগঠন ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ বা কেটিএফের প্রধান।

দুই অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী ৪৬ বছরের নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা করেন। কানাডা সরকারের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের ‘হাত’ রয়েছে। পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশনে তেমনই দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী ট্রু়ডো।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতীয় এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ট্রুডো সরকার। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দাবি, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টদের যোগ থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে তার কাছে। এ বিষয়ে জি-২০ সম্মেলনে তার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয়েছে বলেও জানান ট্রুডো।

আরও পড়ুন: হারদীপ সিং হত্যায় আবারও ভারতের সম্পৃক্ততার কথা বললেন ট্রুডো

তবে ভারতের পক্ষ থেকে কানাডার অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কূটনীতিককে বহিষ্কারের বিষয়েও কড়া সমালোচনা করেছে নয়াদিল্লি।

কানাডার ঢিলের বদলে পাটকেল ছুড়তেও দেরি করেনি ভারত। দেশটিতে নিযুক্ত কানাডার এক শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া যুক্তরাজ্যে ভারতীয় হাই কমিশনের সামনে গত মার্চে খালিস্তানপন্থিদেরকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়।

টিটিএন