আর কত সময় টিকে থাকতে পারবে পর্যটকবাহী নিখোঁজ সাবমেরিন?
আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে আগ্রহী পর্যটকদের নিয়ে নিখোঁজ হওয়া সাবমেরিনের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। ওই ডুবোজাহাজের সন্ধানে ব্যাপক উদ্ধার তৎপরতা চলছে। এতে পাঁচজন পর্যটক ছিলেন। সর্বশেষ জানা যায় যে, সাবমেরিনটিতে আর মাত্র ৭০ ঘণ্টা চলার মতো অক্সিজেন মজুত আছে। এই সময়ের মধ্যে সাবমেরিনটির খোঁজ পাওয়া না গেলে পর্যটকদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, রোববার সাগরে ডুব দেওয়ার এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর ছোট আকারের ওই ডুবোজাহাজটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পানির নিচে যাওয়ার সময় ডুবোজাহাজটিতে সাধারণত চারদিন চলার মতো জরুরি অক্সিজেন থাকে।
দর্শনার্থীদের নিয়ে গত রোববার নিখোঁজ হয় ‘টাইটান’ নামের সাবমেরিনটি। যে অভিযানে গিয়ে টাইটান নিখোঁজ হয়, সেটা ছিল এর তৃতীয় অভিযান। নিখোঁজ ওই সাবমেরিনে পাঁচজন আরোহী ছিলেন। এ ধরনের ছোট আকারের সাবমার্সিবল বা ডুবোজাহাজে সাধারণত একজন চালক এবং তিনজন যাত্রী থাকে। আরেকজন থাকে ‘কনটেন্ট এক্সপার্ট’ যিনি সাগরের নিচের সবকিছু পর্যটকদের কাছে ব্যাখ্যা করেন।
টাইটান ডুবোযানটি ওসানগেট এক্সপিডিশন নামের পর্যটন সংস্থার মালিকানাধীন। ২২ ফুটের এই ডুবোজাহাজ কার্বন ফাইবারের তৈরি। টাইটানের দৈর্ঘ্য ৬.৭ মিটার, প্রস্থ ২.৮ মিটার এবং উচ্চতা ২.৫ মিটার। সমুদ্রের ৪ হাজার মিটার গভীরতা পর্যন্ত নামতে সক্ষম এই ডুবোযান। টাইটানের ওজন ১০ হাজার ৪৩২ কেজি এবং এটি সর্বোচ্চ তিন নটিক্যাল মাইল গতিতে ভ্রমণ করতে পারে। টাইটানের ভেতরে রয়েছে ১০০২টি বৈদ্যুতিক থ্রাস্টার। পাশাপাশি রয়েছে সামুদ্রিক রেফিন ক্যামেরা, ৪০ হাজার লাইট এবং একটি রোবোটিক্স লেজার স্ক্যানার। জাহাজটি ছোট হওয়ায় ইঞ্জিন এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ মূলত বাইরের দিকে রয়েছে। ডুবোজাহাজটির ভেতরে একটি শৌচালয় রয়েছে। টাইটান একটি শক্তিশালী প্লেস্টেশন কন্ট্রোলার দ্বারা পানির বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। যদিও ডুবোযানটিতে কোনো জিপিএস নেই।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেসেজের মাধ্যমে ট্র্যাকিং দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাইটান, যা একটি ‘আল্ট্রা-শর্ট বেসলাইন (ইউএসবিএল)’ সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম। ওই ডুবোজাহাজে যে ক্যামেরাগুলো লাগানো থাকে তার সাহায্যে সমুদ্রের ওপর থেকে জাহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়। টাইটানে একটি মাত্র সুইচ রয়েছে। বাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় ‘টাচ স্ক্রিন’ এবং কম্পিউটারের সাহায্যে।
টাইটান ডুবোজাহাজটি কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ইঞ্জিনিয়াররা ওসানগেটের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে যৌথভাবে এই ডুবোজাহাজ তৈরি করেন।
এক সাক্ষাৎকারে ওসানগেট এক্সপিডিশনের সিইও স্টকটন রাশ জানিয়েছিলেন, সর্বাধিক পাঁচ যাত্রীকে নিয়ে ভ্রমণ করার ক্ষমতা রয়েছে টাইটানের। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ যে গভীরতায় রয়েছে, সেই গভীরতা পর্যন্ত যেতে সক্ষম
এই ডুবোজাহাজ।
২০০৯ সালে ওসানগেট সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন স্টকটন। তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ জেট পাইলট ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি জেট পাইলট হন। ১৯৮৯ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্লাসেয়ার-৩ নামে একটি পরীক্ষামূলক বিমান তৈরি করেছিলেন স্টকটন।
ওশেনগেট জানিয়েছে, সাবমেরিনে থাকা পাঁচ পর্যটককে উদ্ধার করতে সবগুলো বিকল্প যাচাই করে দেখা হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া ডুবোজাহাজটি অনেকটা ট্রাক আকৃতির। এই সাবমেরিনে পাঁচজন উঠতে পারেন। কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জনস থেকে এই ডুবোজাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল। সাধারণত সাগরের তলদেশে ধ্বংসাবশেষের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসতে আট ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ওশেনগেটের তিনটি সাবমার্সিবল থাকলেও টাইটানিকের কাছে যাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে শুধুমাত্র টাইটানের।
সরকারি সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার নৌবাহিনী এবং গভীর সাগরে কাজ করে এমন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের তিন হাজার ৮০০ মিটার বা সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে আটলান্টিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে আটদিনের এই ভ্রমণের জন্য আড়াই লাখ ডলার খরচ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র কোস্ট গার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাউগের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পর্যটকদের জীবিত খুঁজে বের করতে হলে তাদের হাতে ২৬ ঘণ্টার মতো সময় রয়েছে। নিখোঁজ সাবমেরিনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ৫৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ ধনকুবের ব্যবসায়ী এবং অভিযাত্রী হ্যামিশ হাডিং।
১১১ বছর আগে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। এর ধ্বংসাবশেষ ঘিরে আজও রহস্য রয়েই গেছে। এটি ছিল ব্রিটেনের হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানির একটি যাত্রীবাহী জাহাজ। টাইটানিক নির্মাণের পর এর নির্মাতারা গর্ব করে বলেছিলেন, টাইটানিক কোনোদিন ডুববে না। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল গর্বে মাথা উঁচু করেই ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের নেতৃত্বে সে সময়কার সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ টাইটানিক প্রায় ২২২৪ জন যাত্রী নিয়ে ব্রিটেনের সাউথহ্যাম্পটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। যাত্রীদের মধ্যে অনেক ধনী ও তথাকথিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শত শত অভিবাসীও, যারা নতুন জীবনের সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন।
যাত্রার মাত্র ৪ দিন পর ‘আনসিঙ্কেবল’ টাইটানিক একটি বিশাল বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। বিশাল এই জাহাজটির ডুবে যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরে আরএমএস কারপেথিয়া নামের আরেকটি জাহাজ সমুদ্রে বিভিন্নভাবে বেঁচে থাকা টাইটানিকের আনুমানিক ৭১০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে।
১৯৮৫ সালে সমুদ্রের ১২ হাজার ৪১৫ ফুট গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে মার্কিন নেভি; উদ্ধার করা হয় হাজার হাজার শিল্পকর্ম, যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। টাইটানিক নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ, চলচ্চিত্র, গান। দুর্ঘটনা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বশেষ মারা যান মিলভিনা ডিন, ২০০৯ সালে। টাইটানিকডুবির সময় তার বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। আর মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। খবরটিও তখন বিশ্বব্যাপী ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। বস্তুত টাইটানিককে নিয়ে বিগত শত বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু এখনও যেন টাইটানিক নিয়ে মানুষের আগ্রহ শেষ হয়নি।
টিটিএন/এএসএম