ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

সুদানে সংঘাত

গরমে পচে যাচ্ছে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ, বিপাকে বাসিন্দারা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:০০ পিএম, ০৯ জুন ২০২৩

উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানের রাজধানী খার্তুম নিয়ন্ত্রণ নিতে সাত সপ্তাহ ধরে সেখানে সংঘাত চলছে। এই যুদ্ধ-সংঘাতের মধ্যে সেখানকার বাসিন্দারা এমন এক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন যা তারা আগে কল্পনাও করেন নি। শহরের রাস্তায় রাস্তায় যেসব মৃতদেহ পড়ে আছে সেগুলোর ব্যাপারে তারা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমি তিনজনকে তাদের নিজেদের বাড়ির ভেতরে কবর দিয়েছি। আর বাকিদের কবর দিয়েছে আমি যে রাস্তায় থাকি তার প্রবেশ মুখে। তিনি বলেন, কুকুর কামড়ে কামড়ে মৃতদেহ খাচ্ছে ঘরের দরজা খুলে এই দৃশ্য দেখার চেয়ে এটা ভালো ব্যবস্থা।

যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কত মানুষ মারা গেছে এই হিসাব কেউ জানে না। কিন্তু ধারণা করা হয় এই সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। এদের মধ্যে বহু বেসামরিক মানুষ রয়েছে।

আরও পড়ুন>ট্রাম্পকে ৫০ লাখ ডলার জরিমানা

সুদানে সামরিক বাহিনীর দুটি গ্রুপের মধ্যে এই লড়াই চলছে। দেশটির সেনাবাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফ নামের একটি আধাসামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে। এই দুটি গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধবিরতির পরেও রাজধানীর লোকজনের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে কবরস্থানে যাওয়া অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওমর নামের এক ব্যক্তি জানান, কম করে হলেও তিনি ২০ জনকে কবর দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার এক প্রতিবেশী তার বাড়িতে নিহত হয়েছেন। আমি কিছু করতে পারিনি। তবে তার বাড়ির মেঝের সিরামিক টাইলস উঠিয়ে সেখানে একটা কবর খুঁড়ে তাকে মাটি চাপা দিয়েছি।

তিনি বলেন, রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো গরমে পচে যাচ্ছে। আমি কী বলতে পারি? খার্তুমের কিছু কিছু এলাকা এখন কবরস্থানে পরিণত হচ্ছে।

গত মাসে ওমর খার্তুমের আল-ইমতিদাদ এলাকায় তার বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে একটি রাস্তার পাশে চারজনের জন্য কবর খুঁড়েছিলেন। ওমর বলেন, আশেপাশের এলাকার এরকম আরও কয়েকজনকে তিনি চেনেন যাদেরকে ঠিক একই কাজ করতে হয়েছে।

তিনি বলেন, নিহতদের অনেককে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের কিছু এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে। এটা একটা তেলের স্টেশনের পাশে, সবাই এই জায়গাটা চেনে। বাকিদের কবর দেওয়া হয়েছে মোহামেদ নাগিব রোডের কাছের কিছু এলাকায়।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সুদানে ঠিক কতো সংখ্যক লোককে বাড়ির ভেতরে এবং বিভিন্ন বসতি এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে তার কোনো হিসেব নেই। তবে ওমর বলছেন, এই সংখ্যা হবে কয়েক ডজন।

এরকম আরেকজন হামিদ (ছদ্মনাম)। তিনি জানিয়েছেন, তারে অভিজ্ঞতাও একই ধরনের। হামিদ বলেন, তিনি রাজধানী খার্তুম থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শাম্বাত শহরে সেনাবাহিনীর তিন সদস্যকে কবর দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্ত হলে তারা নিহত হন।

আরও পড়ুন>২০২৪ হতে পারে সবচেয়ে উষ্ণ বছর

তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে আমি সেদিন ওই এলাকায় ছিলাম। আরো পাঁচজন লোক নিয়ে আমি মৃতদেহগুলোকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করি। তারপর সেগুলোকে এমন একটা জায়গায় দাফন করি যার পাশ ঘিরে কিছু আবাসিক ভবন।

হামিদ একজন প্রপার্টি ব্যবসায়ী যিনি ওই এলাকায় ২০ বছর ধরে বসবাস করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এই কবর দেওয়াটা তার দায়িত্ব। তিনি বলেন, লাশগুলো আমরা কোথায় কবর দিচ্ছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদেরকে কবর দেওয়ার কাজটাই সবার আগে করতে হবে। এটা একটা দাতব্য কাজ। এসব মৃতদেহ কবরস্থানে নিয়ে যেতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে এবং চোরাগোপ্তা হামলাকারীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সমাজকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি যাতে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি না হয়। এটা আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। তবে ডক্টরস ইউনিয়নের প্রধান ড. আত্তিয়া আব্দুল্লাহ আত্তিয়া বলছেন, ভালো উদ্দেশ্যে এসব মরদেহ কবর দেওয়া হলেও এই উদ্যোগ অনিচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধের তথ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করে দিতে পারে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, এধরনের অপেশাদার উপায়ে কবর দেওয়ার কারণে সত্য চাপা পড়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন এর ফলে লোকজন কী কারণে নিহত হলো তার তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

jagonews24.com

ড. আত্তিয়া বলেন, মরদেহগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলোকে যথাসময়ে ও মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে দাফন করতে হবে। তিনি মনে করেন লোকজনের কবর দেওয়ার পরিবর্তে এই প্রক্রিয়া স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, রেড ক্রস এবং সুদানি রেড ক্রসের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, নিহতদের এভাবে কবর দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। সমাধিস্থ করার এই প্রক্রিয়ায় সরকারি প্রতিনিধি, সরকারি আইনজীবী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং রেড ক্রসের উপস্থিত থাকা দরকার। তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করাও জরুরি।

যে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে, সেখানে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা কিভাবে সম্ভব হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইরের দেশের ভূমিকা রাখা উচিত।

ওমর এবং হামিদ দুজন স্বেচ্ছাসেবীই বলছেন, নিহত ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার আগে তারা তার মুখ এবং দেহের ছবি তুলে রাখেন। তারা মনে করেন, ভবিষ্যতে তাদের পরিচয় শনাক্ত করার ব্যাপারে এসব কাজে লাগতে পারে।

তবে ড. আত্তিয়া সতর্ক করে দিয়েছেন, অনিরাপদ উপায়ে মৃতদেহ কবর দেওয়ার কারণে অসুখ বিসুখও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, মরদেহ যদি খুব বেশি গভীরে চাপা না দেওয়া হয়, তাহলে বেওয়ারিশ কুকুর এগুলো উপরে তুলে ফেলতে পারে। এখানে কবর দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে না। মৃতদেহ যাতে কবর থেকে তোলা না যায় সেজন্য কবরের ভেতরে কঠিন বস্তু অথবা ইট দিতে হবে বলেন জানান তিনি।

তবে হামিদ বলছেন, সুদানের বেশিরভাগ মানুষই জানে মৃতদেহ কিভাবে কবর দিতে হয়। সেখানে মাটির অন্তত এক মিটার গভীরে কবর দেওয়ার নিয়ম। যুদ্ধের মধ্যেও নিহতদের সঠিকভাবে কবর দেওয়ার কিছু কিছু চেষ্টাও আছে।

রেড ক্রসের একজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, তিনি রাস্তা থেকে মৃতদেহ তুলে নেওয়ার কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি মুখ ও দেহের ছবি তুলি, লোকটি কি খুব সম্প্রতি মারা গেছে নাকি মরদেহটি পচে গেছে সেটা রেকর্ড করে রাখি এবং মৃতদেহটিকে একটি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করি।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে নিহত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যায় সেজন্য প্রত্যেকটি মরদেহের ব্যাপারে আলাদা আলাদা ফাইল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ড. আত্তিয়া সতর্ক করলেও লোকজন বলছেন, সরকারি স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে এভাবে কবর দেওয়া ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।

সামাজিক মাধ্যমে গত ১১মে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় দুজন সুদানি নারী চিকিৎসক ম্যাগডলিন এবং মাগদা ইউসেফ ঘালিকে তাদের বাগানে কবর দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভাই জানান, তার দুই বোনকে বাড়ির ভেতরে কবর দেওয়াই ছিল একমাত্র সমাধান। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তাদের মরদেহ প্রায় ১২ দিন ধরে পড়ে ছিল। তিনি বলেন, প্রতিবেশীরা জানায় যে আমাদের বাড়ি থেকে দুর্গন্ধ আসছে। তখন লোকজন বাগানে একই কবরে তাদের দুজনকে কবর দিতে এগিয়ে আসে। এমন পরিস্থিতি হবে সেটা তারা কখনও কল্পনাও করতে পারেননি।

আরও পড়ুন: তাইওয়ানের আকাশসীমায় ৩০টির বেশি চীনা যুদ্ধবিমান

রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহ সেখান থেকে তুলে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ রেড ক্রস এবং সুদানি রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে কাজ করছে। তবে যেসব দল এই কাজ করছে যুদ্ধের কারণে তাদের এসে পৌঁছাতে বিলম্ব ঘটছে।

লোকজন নিহতদের মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে কবর দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধের মধ্যে তারা নিজেরাও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এরকম সহিংস পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সম্ভাবনাও সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে।

টিটিএন