ফরেন পলিসির বিশ্লেষণ
গৌতম আদানি ও ভারতের নয়া পুঁজিবাদ
ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই চলছিল। বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানেও উঠে আসেন ২০২২ সালে। চলতি বছরের শুরুতে, ইন্ডিয়া টুডে তাকে ‘প্রবৃদ্ধির রাজা’ বলেও অভিহিত করে। বছরের শুরুতেই সংবাদপত্রের শিরোনামেও বারবার ওঠে আসে আদানির নাম।
বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আদানি গ্রুপ আরও ভালো কিছু নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছিল এবং সংগ্রহ করবে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে আদানি ও তার গ্রুপকে অপরাজেয় বলেই অনেকটা ধরা হয়েছিল।
আদানি এখনো সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে রয়ে গেছেন তবে ভিন্ন কারণে। নিউইয়র্কভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়। অভিযোগ ওঠে আদানি গ্রুপ তার স্টক মূল্য ও বাজার দরকে ‘রাউন্ড ট্রিপিং’ করে বাড়িয়েছে। অস্পষ্ট কোম্পানিগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং ট্যাক্সের জন্য নিবন্ধিত করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন বলছে, করর্পোরেট ইতিহাসে আদানি সবচেয়ে বড় ‘জালিয়াতি’ করেছেন।
যদিও আদানি গ্রুপ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিউইয়র্কের একটি শীর্ষ আইনি সংস্থাকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
স্টক মার্কেটে আদানি গ্রুপের শেয়ার দর পড়ে যাচ্ছিল। প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস চারটি আদানি গ্রুপের স্টককে নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে। মর্গ্যান স্ট্যানলি ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল আদানি গ্রুপের স্টককে দেওয়া লেনদেন কমিয়েছে এবং শেয়ারের দামে নিম্নমুখী চাপ বাড়িয়েছে। এস অ্যান্ড পি ডো জোনস ইনডিসেস টেকসই সূচক থেকে স্টকগুলো সরিয়ে দিয়েছে। নরওয়ের সার্বভৌম সম্পদ ফান্ড তার হোল্ডিং বিক্রি করেছে এবং ক্রেডিট সুইস ও সিটি গ্রুপ বলছে যে তারা আর আদানি গ্রুপের সিকিউরিটিজকে জামানত হিসেবে গ্রহণ করবে না।
যদিও বাজারের প্রতিক্রিয়া শিরোনামে প্রাধান্য পেয়েছে, তবে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ঠিক ততটাই কম। আদানির একজন শীর্ষ নির্বাহী প্রতিবেদনটিকে ভারতের ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে জবাব চেয়েছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সংসদে আদানির সঙ্গে মোদীর কথিত সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যা পরে সরকারি রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হয় বলে অভিযোগ আছে।
আদানির সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক জোরালো ও গভীর বলে ধরা হয়। ভারতের বেসরকারি খাত বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু আদানির উত্থান বিশেষভাবে দর্শনীয় ছিল। আদানির উত্থান মোদীর ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গেও মিলে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আদানির উত্থান ঠিক জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার টাইকুনদের অনুরুপ। তারা শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে নিজেদের জন্য একচেটিয়া অধিকার থেকে উপকৃত হয়। যেমন সাবেক ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস, সাবেক ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো, বা মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, তারা সবাই ১৯৭০ এর দশকের শেষ থেকে ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দায়িত্ব পালন করেন।
মোদীর ক্ষমতায় থাকাকালীন আদানি গ্রুপ উল্লেখযোগ্যভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে। আদানি নিজেই ২০০২ সাল থেকে রাজনীতিবিদদের জন্য একজন পৃষ্ঠপোষক বনে যান। গুজরাটে ভয়াবহ দাঙ্গায় ব্যবসায়িক আস্থা ক্ষুন্ন হয়। মোদী ২০০১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেখানে গুজরাট তার উদ্যোগে পরিচিত, কিন্তু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। আদানি মোদীকে উদ্ধারে এগিয়ে যান। গুজরাটি ব্যবসায়ী নেতাদের রাজ্যের স্থিতিস্থাপকতায় বিনিয়োগ করতে একত্রিত করেছিলেন আদানি। ফলে যারা সমালোচনা করেন মোদী তাদের ভুলে যান না, তবে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদেরও তিনি মনে রেখেছেন।
মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, আদানি গুজরাটের মুন্দ্রায় ভারতের বৃহত্তম ব্যক্তিগত বন্দরসহ রাজ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে, আদানি গ্রুপ ভারতের বন্দর ক্ষমতার এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন বিমানবন্দর পরিচালনা করার অধিকার পায়। পরে তিনি ভারতের দ্বিতীয় ব্যস্ততম ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৪ শতাংশ শেয়ারও যোগ করেন তার ঝুলিতে। ২০২১ সালে, আদানি গ্রুপ একটি উচ্চাভিলাষী গ্রিন এনার্জি প্রকল্প ঘোষণা করে। যদিও মোদীর সমর্থকরা তাকে তথাকথিত গুজরাট মডেল তৈরি করার জন্য কৃতিত্ব দিতে পারে, যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
গুজরাটের সংস্কৃতিতেই ব্যবসায়িক দক্ষতা নিহিত। রাজ্যটির ভারতের বৃহত্তম উপকূলরেখা রয়েছে এবং গুজরাটি ব্যবসায়ীরা ভারত মহাসাগর ও তার বাইরে ব্যবসা করার জন্য এই উপকূল ব্যবহার করছে। সাধারণ গুজরাটি টাইকুনরা সরকারকে বিচলিত করতে চান না, তবে তারাও চান না রাষ্ট্র ব্যবসায়িক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক।
একজন বুদ্ধিমান বণিকের ভূমিকা হিসেবে যিনি রাজ্যকে পরিচালনা করেন, যারা ঋণদাতা, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকারের কাজ করেছিলেন তাদের একটি উদাহরণ আছে। পাঁচজন গুজরাটিসহ আটজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ১৯৪৪ সালে ভারতের অর্থনীতির জন্য বোম্বে প্ল্যান লিখতে একত্রিত হয়েছিলেন। তখন তারা বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে ব্যবসা রক্ষা করে এবং রাষ্ট্রকে অবকাঠামো তৈরি করতে দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার অনুশীলন হিসেবে বিবেচনা করেন।
আজকের ভারতীয় পুঁজিবাদ অতীতের চেয়ে আলাদা। স্বাধীনতার পরের দশকগুলোতে ভারত অর্থনীতিকে উদারীকরণ করে।
সে সময় কোম্পানিগুলোকে পুঁজি বাড়াতে বা সম্প্রসারণের জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। তখন ভারতীয় ব্যবসা কীভাবে একটি ‘বাইজেন্টাইন আমলাতন্ত্র’ আয়ত্ত করতে পারে তা খুঁজে বের করার প্রয়াস ছিল। বেসরকারি ব্যবসার ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা ছিল, তারা কর্মীদের ছাঁটাই করতে পারে কি না বা কোন খাতে তারা বিনিয়োগ করতে পারে, এমন সব বিষয়ে। কিন্তু ১৯৯১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিংহ রাও ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছিলেন। যদি পুরোনো গুজরাট মডেল ব্যবসা-বাণিজ্যকে সরকারের তাঁবু থেকে দূরে রেখে সফল করে তোলে। তবে মোদী ও আদানি যে সংস্করণটি গ্রহণ করেছেন তা এখন রাজ্য ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সংযোগ অস্পষ্ট করে তুলেছে।
লেখক: সলিল ত্রিপাঠী, নিউইয়র্কভিত্তিক লেখক। তিনি গুজরাটিদের নিয়ে একটি বইও লিখছেন।
এসএনআর/জিকেএস