জিদান থেকে এমবাপে
অভিবাসী সন্তানদের নিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে ফ্রান্সের ফুটবল
১৯৯৮ সালের ১২ জুলাই। এদিন রোনালদো, রিভালদো, কার্লোসের মতো তারকাসমৃদ্ধ ব্রাজিলকে বিধ্বস্ত করে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারায় লা ব্লুজরা। ওই ম্যাচে দুই গোল করে ফরাসিদের নায়কে পরিণত হন জিনেদিন জিদান।
কিন্তু সাবেক এ ফুটবলার পুরোপুরি ফরাসি নন। তার শিকড় রয়েছে আলজেরিয়ায়। শুধু জিদানই নন, বিশ্বকাপজয়ী ওই দলে আর্মেনীয়, ঘানাইয়ান, সেনেগালিজ, গুয়াদেলোপীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়ও ছিলেন বেশ কয়েকজন।
ঔপনিবেশিক শাসনের অতীত ঢাকতে হিমশিম খেতে থাকা ফ্রান্সের জন্য বিশ্বকাপ জয় হয়ে উঠেছিল মোক্ষম ওষুধ। ফরাসিদের ১৩২ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো আলজেরীয় স্বাধীনতা যুদ্ধকে (১৯৫৪-৬২) ফ্রান্স যুদ্ধ বলে স্বীকৃতিই দিয়েছে এই ১৯৯৯ সালে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফ্রান্স টিম। ছবি সংগৃহীত
১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের ঘটনাকে সেসময় ফরাসি মিডিয়ায় একত্রীকরণের সফল উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। ফরাসি সংবাদপত্র লে মন্ডে এটিকে ফ্রান্সের ‘বৈচিত্র্য ও ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে উল্লেখ করে। তৎকালীন ফরাসি প্রেসেডন্ট জ্যাক শিরাক তাদের ‘বহুবর্ণের দল’ হিসেবে বর্ণনা করেন, যা ‘ফ্রান্স ও এর মানবতার একটি সুন্দর চিত্র’ তৈরি করেছিল।
এর দু’বছর পরেই ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে ফরাসি টিম। এখানেও জয়ের নায়ক জিনেদিন জিদান। দুর্দান্ত খেলে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।
এরপর বেশ চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে ফ্রান্সকে। ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ, ২০১৬ সালে পর্তুগালের কাছে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে হারের ধকল সামলাতে হয়েছে তাদের। এরপর ২০১৮ সালে আবারও বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের টিম। ছবি সংগৃহীত
২০ বছর আগের মতো ওই টিমেও ছিল ভিন্ন জাতি-বর্ণের খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। ২৩ সদস্যের ফরাসি স্কোয়াডে অন্তত ১৭ জনই অন্য একটি দেশে খেলার যোগ্য ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম কিলিয়ান এমবাপে। তার বাবা ক্যামেরুনের এবং মা আলজেরিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। ওই টুর্নামেন্টে সেরা তরুণ খেলেয়াড় নির্বাচিত হন এমবাপে।
অসাধারণ খেলা আরেকজন হলেন পল পগবা। তিনি গিনিয়ান পিতা-মাতার সন্তান ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
২০১৮ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের সাফল্য শুধু ফ্রান্স দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একই টুর্নামেন্টে ফ্রান্সে জন্ম বা প্রশিক্ষণ নেওয়া অন্তত ২৮ জন খেলোয়াড় অন্য দলের হয়ে খেলেছিলেন।
আজ ফরাসি টিমের হয়ে ১০০’র বেশি ম্যাচ খেলা নয়জন ফুটবলারের মধ্যে পাঁচজনই অ-ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত।
বৈচিত্রের দীর্ঘ ইতিহাস
ফরাসি ফুটবল ও অভিসানের মধ্যে সম্পর্কের শুরু খুঁজতে হলে যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে। ওই সময় আরসি লেন্স, এএস সেন্ট এতিয়েনের মতো বেশ কয়েকটি ক্লাব গড়ে উঠেছিল পোলিশ ও ইতালীয় অভিবাসী অধ্যুষিত খনি এলাকার আশপাশে। সেখান থেকে উঠে আসা অন্যতম বিখ্যাত খেলোয়াড় হলেন স্টেফান ডেম্বিকি বা স্ট্যানিস। ফ্রান্সে কোনো পেশাদার ম্যাচে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড তার দখলে। ১৯৪২ সালে ‘ক্যুপ ডি ফ্রান্স’র প্রথম রাউন্ডের এক ম্যাচে আরসি লেন্সের হয়ে ১৬বার বল জালে জড়িয়েছিলেন ডেম্বিকি।
নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে ফরাসি টিমের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে রাউল ডায়াগনেকে মাঠে নামায় ফ্রান্স। দুর্দান্ত এ ডিফেন্ডারকে ফরাসিরা ‘দ্য ব্ল্যাক স্পাইডার’ নাম দিয়েছিল। রাউলের জন্ম ফরাসি গায়ানায় হলেও তিনি ছিলেন সেনেগালিজ বংশোদ্ভূত।
ওই বছরই মরক্কোয় জন্ম নেওয়া লার্বি বেনবারেক ইউএস মারোকেইন ক্যাসাব্লাঙ্কা ক্লাব থেকে ফ্রান্সের অলিম্পিক ডি মার্সেইতে স্থানান্তরিত হন এবং প্রথম মৌসুমেই ১০ গোল করেন। এরপর ফ্রান্সের জাতীয় দলের হয়ে ১৯বার এবং স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে ১১৩বার মাঠে নেমেছেন তিনি। তার সম্পর্কে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার পেলে বলেছিলেন, ‘আমি যদি ফুটবলের রাজা হই, তবে লার্বি বেনবারেক এর ঈশ্বর’।
#OnThisDay in 1954, the legendary Larbi Benbarek, who was posthumously awarded the FIFA Order of Merit in 1998, earned his final international cap, becoming France's oldest player at the age of 40 years and 5 months - a record that stands to this day. #FiersdetreBleus pic.twitter.com/CBK71UVWIS
— French Team (@FrenchTeam) October 16, 2019
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে উত্তর আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চলে ফ্রান্সের উপনিবেশ ও রক্ষিত রাজ্যগুলো থেকে স্থানান্তরিত হওয়া খেলোয়াড়রা ফরাসি ফুটবলকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করেন। তাদেরই একজন রশিদ মাখলুফ। ১৯৫৬-৫৭ সালে এএস সেন্ট-এতিয়েনের হয়ে ফ্রেঞ্চ ডিভিশন জেতার পরপরই ফ্রান্সের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পান তিনি।
তবে প্রস্তুতির মাঝপথে আরও কয়েকজন আলজেরীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়কে নিয়ে রশিদ চলে যান আলজেরিয়ায়। এসময় সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল। সেখানে আলজেরিয়ান ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের সশস্ত্র সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (এফএলএন) অধীনে গঠিত একটি দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন তারা। ১৯৬২ সালে এফএলএন ভেঙে যাওয়ার পর ফ্রান্সে ফেরেন রশিদ। এসময় তাকে নায়কোচিত অভ্যর্থনা দিয়েছিল সেন্ট-এতিয়েন।
রশিদ মাখলুফ (ডানে)। ছবি সংগৃহীত
১৯৭০ এর দশকে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে ফুটবল কাঠামো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় ফ্রান্স। এরপর আধুনিক অ্যাকাডেমি ব্যবস্থার হাত ধরে উঠে আসতে থাকে অন্য দেশের বংশোদ্ভূত তরুণ ফুটবলাররা।
এদের মধ্যে অন্যতম সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন হিসেবে বিবেচিত মারিয়াস ট্রেসর ও বিখ্যাত মিডফিল্ডার আমাদু টিগানা। ট্রেসরের জন্ম গুয়াদেলুপেতে এবং টিগানার জন্ম মালিতে।
১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে অভিবাসনের অতীত থাকা অনেক খেলোয়াড়ই ফরাসি টিমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেমন- থিয়েরে অঁরি। ফ্রান্সের পক্ষে যৌথভাবে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা অঁরির জন্ম গুয়াদেলুপ ও মার্টিনিক থেকে যাওয়া বাবা-মায়ের ঘরে।
থিয়েরে অঁরি (ডানে)। ছবি সংগৃহীত
এই মুহূর্তে বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে থাকা ফ্রান্সের বর্তমান টিমের বেশিরভাগ সদস্যের শিকড়ও অন্য কোনো দেশে। যেমন- দায়োট উপমেকানো গিনি-বিসাউ বংশোদ্ভূত এবং অরেলিয়ান চৌমেনি ক্যামেরুনিয়ান বংশোদ্ভূত।
এছাড়া, ফ্রান্সের হয়ে খেলা যে পাঁচ ফুটবলার এ পর্যন্ত ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, তাদের মধ্যে চারজনই অভিবাসী বংশোদ্ভূত। এদের মধ্যে রয়েছেন লিজেন্ডারি রিয়েল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার রেমন্ড কোপা। তিনি পোলিশ অভিবাসীর সন্তান। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলায়াড় হিসেবে বিবেচিত মিশেল প্লাতিনি ইতালীয় বংশোদ্ভূত। আর জিদান ও করিম বেনজেমার শিকড় আলজেরিয়ায়।
সূত্র: আল জাজিরা
কেএএ/