ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীদের হলুদ জার্সি পরতে আপত্তি কেন?
ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। সেই দেশের একজন অতিউৎসাহী ফুটবলপ্রেমী হিগর রামালহো। বিশ্বকাপ ঘনিয়ে আসায় স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। অথচ ২০১৮ সালের জুন মাস থেকেই আলমারিতে ঝোলানো তার হলুদ রঙের জার্সিটি। সবশেষ নিজের জন্মদিনে এটি পরেছিলেন হিগর। জার্সিটি আর কোনোদিন পরবেন কি না তাও জানেন না তিনি। কেন? হলুদ ওই জার্সির সঙ্গে যে রাজনীতি মিশে গেছে।
ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল দলের ঐতিহ্যবাহী হলুদ জার্সিটি ‘ক্যানারিনহো জার্সি’ নামে পরিচিত। তবে এটি চিরকাল জাতীয় দলের জার্সি ছিল না। মারাকানা বিশ্বকাপ ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে যাওয়ার তিন বছর পর ১৯৫৩ সালে নকশা করা হয়েছিল ব্রাজিলের হলুদ জার্সি। এর আগে তাদের জাতীয় দলের জার্সি ছিল সাদা রঙের।
ওই বছর ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল কর্তৃপক্ষ একটি পত্রিকার সঙ্গে মিলিতভাবে নতুন জার্সির নকশা বিষয়ক একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। শর্ত ছিল, জার্সিতে জাতীয় পতাকার রঙ থাকতে হবে। ওই প্রতিযোগিতায় তিন শতাধিক নকশা জমা পড়ে। তাতে জয়ী হন অ্যালডির গার্সিয়া শ্লি নামে এক ডিজাইনার।
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটি ফুটবল বিশ্বকাপ ও ছয়টি কোপা আমেরিকা ট্রফি জিতেছে ব্রাজিল, আর হলুদ জার্সি হয়ে উঠেছে ব্রাজিলিয়ান ভক্তদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সৌভাগ্য ও ঐক্যের প্রতীক।
ব্রাজিলের ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের ছবি। ছবি সংগৃহীত
কিন্তু এই জার্সিকেই বহুবার বহুভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। সবশেষ এটি করেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো ও তার সমর্থকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের যে ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো জাতীয় দল ও দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে সাহায্য করেছিল, সেই ঐক্যের বিরোধী ধারণাগুলো প্রচার করতে মাঠের বাইরে হলুদ জার্সি ব্যবহার করা হচ্ছে।
২২ বছর বয়সী হিগর বলেন, হলুদ জার্সি পরা আমার কাছে একটি গর্বের মুহূর্ত ছিল। এটি ছিল বিজয়ের প্রতীক। এই জার্সি আমি শুধু ম্যাচ দেখার সময়ই নয়, অন্য দিনগুলোও পরতাম। কিন্তু এখন রাজনৈতিক কারণে এটি পরা বন্ধ করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকরা হলুদ জার্সিকে রাজনৈতিক প্রচারণা ও তাদের রাজনৈতিক দলের প্রতীকে পরিণত করেছেন। আর যেহেতু আমি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে সমর্থন করি না, তাই চাই না, কেউ আমাকে ভুল করে হলেও তাদের একজন মনে করুক।
হলুদ জার্সি পরে বলসোনারো সমর্থকদের প্রচারণা। ছবি সংগৃহীত
২৫ বছর বয়সী ইসাবেলা গুয়েদেস বলেন, ফুটবল ব্রাজিলের জন্য ঐতিহাসিক বিষয়। বেশিরভাগ সময় এটিই সবাইকে একত্রিত করে। কিন্তু যখন তারা [ডানপন্থি সমর্থকরা] দেশের জন্য অর্থপূর্ণ কিছু নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, তখন মনে হয়, তারা আমাদের কাছ থেকে এটি চুরি করছে।
তিনি বলেন, বিশ্বকাপের সময় আমার জানালায় পতাকা ঝুলিয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কারণ আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক ভেবে মানুষ ভুল কতে পারে। তারা পতাকা ও হলুদ জার্সি নিয়ে সেগুলোকে রাজনৈতিক প্রতীকে রূপান্তরিত করেছে।
তবে কেবল বলসোনারো সমর্থকরাই এই কাজ প্রথম করেননি। ১৯৭০ সালে দেশটির সামরিক স্বৈরশাসকরা জাতীয় পতাকা ও দলের ভাবমূর্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন। ব্রাজিলের তৎকালীন সামরিক নেতা জেনারেল মেডিসিও মেক্সিকো বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দলের কোচকে অপসারণেও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
২০১৩ সালের বিক্ষোভে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লোকেরা হলুদ জার্সি পরে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের আন্দোলন ছিল জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে।
হলুদ জার্সি পরা প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। ছবি সংগৃহীত
আবার, ২০১৪ সালে নির্বাচনের সময় মধ্যম-ডানপন্থি প্রার্থী অ্যাসিও নেভেস নিজের প্রচারণায় ব্রাজিলিয়ান পতাকার রঙ ব্যবহার করেছিলেন।
বছর দুয়েক আগে ব্রাজিলের লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা জোয়াও কার্লোস অ্যাসুম্পকাওর নেতৃত্বে একটি প্রচারণায় জাতীয় ফুটবল সংস্থাকে বিখ্যাত হলুদ জার্সি বাতিল এবং সাদা-নীল জার্সি ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়েছিল। অ্যাসুম্পকাও সেসময় বলেছিলেন, আমাদের পতাকা চুরি করা একটি ভয়ংকর সরকার নিয়ে আমরা খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রয়েছি।
ওই সময় ফোলহা দে সাও পাওলো সংবাদপত্রসহ বেশ কয়েকটি গণতন্ত্রপন্থি দল ডানপন্থি প্রচারণার সঙ্গে জাতীয় পতাকার রঙ আলাদা করার দাবি তুলেছিল। ‘গিভ ব্যাক আওয়ার ফ্লাগ’ হ্যাশট্যাগও চালু হয়েছিল তখন।
সাও পাওলোর ফুটবল জাদুঘরের গ্রন্থাগারিক ও ইতিহাসবিদ আদেমির টাকারা বলেন, ফুটবল সবার জন্য। বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ, বৈষম্য প্রচার করে এমন লোকেরা এটি (হলুদ জার্সি) ব্যবহার করা আমি পছন্দ করি না। জার্সিটি বরং এর বিপরীত। এটি ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু জার্সিটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এটি আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে।
হলুদ জার্সি পরে পতাকা হাতে বলসোনারো সমর্থকরা। ছবি সংগৃহীত
নির্বাচন সামনে রেখে গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে রিও ডি জেনিরোর কোপাকাবানা সৈকতে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার বলসোনারো সমর্থক। সেদিন তাদের অনেকেই হলুদ জার্সি পরেছিলেন।
তবে গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সাবেক পেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা। ব্রাজিলের ২০০তম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন, ৭ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের জন্য ভালোবাসা ও মিলনের দিন হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, আজ তা ঘটছে না। তবু আমি বিশ্বাস করি, ব্রাজিল তার পতাকা, তার সার্বভৌমত্ব ও তার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবে।
সূত্র: আল-জাজিরা
কেএএ/