মাহসা আমিনির মৃত্যু: প্রতিবাদের ঢেউ কীভাবে সামলাবে ইরান?
কাব্যিক দৃশ্যও কখনো কখনো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ চলাকালে আগুনের সামনে স্কার্ফ খুলে হাতে নিয়ে প্রতিবাদ করছেন এক তরুণী। একাকী এক বৃদ্ধা, তার সাদা চুল খুলে, ‘খামেনির মৃত্যু!’ শব্দধ্বনি শুনতে শুনতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং তার শাসনের বিরুদ্ধে এই তীব্র প্রতিবাদ।
ইরানে জনসম্মুখে নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরাসহ কঠোর পর্দা পালনের নিয়ম রয়েছে। এই বিধিগুলো তদারক করার জন্য রয়েছে দেশটির ‘নৈতিকতাবিষয়ক’ পুলিশ। এই পুলিশের একটি দল, গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনিকে তেহরান থেকে আটক করে। আমিনি তার পরিবারের সঙ্গে তেহরানে ঘুরতে গিয়েছিলেন। আটকের পর মাহসা আমিনি থানায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মাহসা আমিনির। এ ঘটনার প্রতিবাদে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইরানের ডজনখানেকের বেশি শহরে। নিন্দার ঝড় বইছে বিশ্বব্যাপী। বহু বছর ধরে আয়াতুল্লাহ খামেনির ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী আন্দোলন হচ্ছে এবার। বিক্ষোভ চলাকালে ইরানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে প্রাণ গেছে অন্তত ৮৩ জনের।
ব্যক্তিগত সাহস সম্মিলিতভাবে বিপ্লবের সূচনা করে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২, আলোচিত আরব বসন্তের কয়েক বছর কেটে গেছে। পুলিশের দুর্নীতির প্রতিবাদে ২০১০ সালে তিউনিসিয়ার সিদি বাওজিদ এলাকার ফুটপাতের সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বাওয়াজিজি নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। সেই ঘটনা থেকে হয় জন্ম আরব বসন্তের। ২৬ বছর বয়সী ওই যুবকের আত্মাহুতির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশটিতে। আন্দোলনে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলী। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা বেন আলীর শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
তিউনিসিয়ার বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকা শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে বাহরাইন, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। বেশ কিছু বছর ধরে কয়েকবার ইরানিরা তাদের দেশের শাসনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হয়েছে। এবারও দমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জন্ম হলো। তবে এখনকার আন্দোলনের সময়টা কি ভিন্ন হতে পারে?
এটা ভবিষ্যৎ বাণী করা প্রায় অসম্ভব। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার বিক্ষোভ বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইরানে। তরুণদের সঙ্গে বয়স্করাও অংশ নিয়েছেন আন্দোলনে। কুর্দিসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও অংশ নিচ্ছেন এতে। তবে এখন পর্যন্ত নারীরাই সবচেয়ে সাহসিকতা দেখিয়েছেন এবারের আন্দোলনে। তবে ইরানের পুরুষরা যদি সমান মাঠে নামে তাহলে একটি ‘জঘন্য’ ব্যবস্থাকে অপসারণ করা, যদিও স্বল্পমেয়াদে এখনো অসম্ভব তবে অকল্পনীয় নয়।
চলমান বিক্ষোভে নারীদের ভূমিকা নতুন। আরেকটি পার্থক্য হলো দাবির বিষয়গুলোও বাস্তবে কঠিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সমসাময়িক তরুণরাও সামিল হচ্ছে আন্দোলনে। ২০১২ সাল থেকে মাথাপিছু আয় স্থবির হয়ে পড়েছে ইরানের। ফলে ৮৫ মিলিয়নের বেশি লোক কঠিন জীবনযাপন করছে দেশটিতে। ইরানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রাকৃতিক কারণে। নদীগুলোর পানি শুকিয়ে গেছে। চাষের জমি শুকিয়ে গেছে। অনেক ইরানির কাছে এখন একটি বিকল্প হতে পারে দেশ ছাড়া যাওয়া।
ইরানের শাসনব্যবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। অভিযোগ আছে, ইরানের সমস্যা বিদেশিদের ওপর দোষ চাপানো। নিশ্চিতভাবেই, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলো অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে আরও গভীর করেছে, কিন্তু জনগণের দারিদ্র্যের জন্য প্রধান দায়ী দেশটির শাসন ব্যবস্থাই। অর্থনীতির কিছু অংশে সামরিক লোক এবং আয়াতুল্লাহদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নীতিগুলো একরোখা। ইরানের পার্লামেন্টে কট্টরপন্থিরা আধিপত্য বিস্তার করে, এবং তুলনামূলকভাবে সংস্কারমনা রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হয়।
তা ছাড়া, কয়েক দশকের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কারণে ইরান আইসোলেটেড হয়ে পড়েছে। দেশটি ইরাক ও লেবাননে মিলিশিয়া ও সিরিয়া, ইয়েমেনে নৃশংস নেতাদের সমর্থন করে। ইরান উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য হুমকি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি পারমাণবিক পরিকল্পনার সঙ্গে টিকে থাকে যা ইসরায়েলকে আতঙ্কিত করে এবং এই অঞ্চলকে বিচলিত করে এমনটাও বলা হচ্ছে। বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলেও, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের এতে মাথা ঘামানোর ঝুঁকি নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মনে করছেন অনেকে।
স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বিদ্রোহকে উত্সাহিত করার জন্য পশ্চিমারা খুব কমই আগ্রহী হতে পারে কারণ বিশ্বের অন্যত্র যুদ্ধ চলছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানের শাসনকে দুর্বল করেছে, তবে পরিবর্তন আনতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। বলা হচ্ছে, তেল সমৃদ্ধ ইরান মানবাধিকার নিয়ে পরোয়া করে না, বিশেষ করে চীনের মতো। ইরানের সঙ্গে চীনের ভালো অর্থনৈতিক সখ্যতা রয়েছে।
ইরানের সাহসীদের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলো যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পারে তা হলো তাদের সেন্সরশিপ এবং নজরদারি এড়াতে সহায়তা করা। দেশটির ইন্টারনেট সেবার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানের কঠোর শাসন থেকে মুক্তি পেতে তাদেরকেই লড়াই করতে হবে। এখন পর্যন্ত বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হচ্ছে। কোনো সম্ভাব্য নেতার আবির্ভাব হয়নি। তবে সবশেষ বিদ্রোহও শেষ পর্যন্ত ম্লান হতে পারে, যেমনটি আগেরগুলো হয়েছিল।
সূত্র: দ্যা ইকোনমিস্ট
এসএনআর/এএসএম