যে উপায়ে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করছে বিভিন্ন দেশ
করোনাভাইরাস মহামারি, খরা, তীব্র দাবদাহ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বেই জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তেল ও গ্যাসের দাম অত্যধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য, পরিবহন, পরিষেবা সবকিছুর খরচই বেড়েছে। এক কথায় জীবনযাত্রার ব্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেসব সামাল দিতে লোকজনকে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
এর ফলে প্রায় সব দেশের সরকারের ওপরই বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে ব্যয় কমিয়ে অভিনব সব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
জ্বালানি সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে ইউরোপে। ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ওয়ান পাইপলাইন দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ প্রথমে সীমিত এবং পরে পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে এই মহাদেশে জ্বালানির মূল্য হু হু করে বেড়ে যেতে শুরু করে।
ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাসের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এর ফলে এসব দেশের সরকার জ্বালানির অপচয় কমানোর ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
হিটার ও এসির ব্যবহার কমানো
চলতি বছর শীতের মৌসুমে গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর একটি পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একই সঙ্গে ১ নভেম্বরের মধ্যে তাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ যেন ৮০ শতাংশ পূর্ণ থাকে সেটাও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
জার্মানি, ফ্রান্স এবং স্পেনের সরকার জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে নতুন কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনায় সরকারি ভবনগুলোতে হিটিং সীমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব আদেশে বলা হয়েছে, সরকারি ভবনে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা যেন ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না ওঠে।
যেসব ভবনে এয়ার কন্ডিশনার বা এসি ব্যবহার করা হয় সেসব ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা কত হবে সেটাও নির্ধারণ করে দিয়েছে ফ্রান্স ও স্পেনের সরকার। ফ্রান্সে এই তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২৬ এবং স্পেনে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে বলা হয়েছে।
ফ্রান্সে যেসব দোকানপাটে এসি আছে সেগুলোর দরজা সবসময় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আদেশ ভঙ্গ করলে ৭৫০ ডলার জরিমানা করা হবে। ফরাসি সরকার মনে করে তারা যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তার ফলে জ্বালানির ব্যবহার ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর জার্মানি যতটা নির্ভরশীল, প্রতিবেশি ফ্রান্স ততটা নির্ভরশীল নয়। ফ্রান্সে বিদ্যুতের ৪২ শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। তবে দেশটিতে চলতি বছর নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ ও খরা দেখা দিয়েছে। এর ফলে বেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চুল্লি ঠাণ্ডা রাখার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা বলছে, ইউরোপের দেশগুলোতে শুধুমাত্র হিটিং কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে রাখার মতো সাধারণ কিছু পদক্ষেপ নিলে অনেক জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। এর পরিমাণ নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন দিয়ে শীতকালে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান।
বাতি নিভিয়ে রাখা
জার্মানি ঘোষণা করেছে যে, তারা রাতের বেলায় সরকারি ভবন ও স্মৃতিসৌধের মতো স্থাপনাগুলোতে আলো জ্বালাবে না। স্পেনের দোকানপাটেও রাত ১০টার মধ্যে বাতি নিভিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো
চীনের জ্বালানি সংকট ভিন্ন ধরনের। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চীনে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ তেমন একটা বিঘ্নিত হয়নি, তবে দেশটি চলতি বছর ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও খরায় আক্রান্ত হয়েছে।
এর ফলে দেশটির নদী নালা শুকিয়ে গেছে যার প্রভাব পড়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর। উদাহরণ হিসেবে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই শহরে যতো বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার ৮০ শতাংশই আসে জলবিদ্যুতের বাঁধ থেকে।
কিন্তু নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে সেখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।পরিস্থিতি সামাল দিতে সিচুয়ান কর্তৃপক্ষ সব কলকারখানা ছয়দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর জন্য সিচুয়ান প্রদেশের সব অফিস এবং দোকানপাটে বাতি না জ্বালানোর পাশাপাশি এসি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিবেশী চংকিং রাজ্যেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানোর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে। এই প্রক্রিয়ায় আকাশে মেঘের ভেতরে কিছু রাসায়নিক পদার্থ পাঠানো হয় যা বৃষ্টিপাত ঘটায়। তবে কবে এটা করা হবে এবং কোথায় করা হবে এসব বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
কম কাজ করা
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সরকারি অফিসে কাজের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জুন মাসে তারা ঘোষণা করে যে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এখন থেকে সপ্তাহে ছয়দিনের পরিবর্তে পাঁচদিন কাজ করবেন।
কিন্তু এর মাত্র কয়েক মাস আগে দেশটির নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তাদের কার্যকারিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই পাকিস্তানে এতো গরম পড়ে যে, এক পর্যায়ে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছায়। এর ফলে দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহের জাতীয় গ্রিডে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়। একই সময়ে সারা বিশ্বে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। এর ফলে দেশটিতে এখন শুক্রবার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাড়ি থেকে কাজ করার পরিকল্পনাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
পরমাণু বিদ্যুৎ
জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ফিরে গেছে। জার্মানিতে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পুনরায় চালু করা হয়েছে।
অথচ জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানোর লক্ষ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে উন্নত দেশগুলো কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা ঘোষণা করেছিল। চলতি বছরের জুনে ভারত থেকে সারাবিশ্বে যে পরিমাণ কয়লা রপ্তানি করা হয়েছে তা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু এর আগে ভারত সরকার কয়লা রপ্তানি কমিয়ে আনার কথা বলেছিল। এর বিকল্প চিন্তাভাবনাও রয়েছে কোনো কোনো দেশের। এর মধ্যে একটি জাপান। প্রায় ১১ বছর বিরতির পর দেশটি নতুন নতুন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার জের ধরে জাপানে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জাপান কর্তৃপক্ষ এখন এসব কেন্দ্র পুনরায় চালু করার কথা বিবেচনা করছে।
সূর্যের আলো
বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন বর্তমান এই সংটের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই ফ্রান্স বায়ুশক্তি থেকে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা এবং চীনের মত দেশ সৌরশক্তির উপর জোর দিচ্ছে। তারা তাদের নাগরিকদের উৎসাহিত করছে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানোর জন্য। বাড়ির ছাদে উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের জন্য বিক্রি করার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে এখন নীতিমালাও তৈরি করা হচ্ছে।
টিটিএন/জিকেএস
সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক
- ১ বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান, নিহত ৬, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ
- ২ প্রথমদিনই চীন-মেক্সিকো-কানাডার ওপর বাড়তি শুল্ক বসাবেন ট্রাম্প
- ৩ চিন্ময় কৃষ্ণকে মুক্তি না দিলে সীমান্ত অবরোধের হুঁশিয়ারি বিজেপির
- ৪ লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় একদিনে ৩১ জন নিহত
- ৫ রাশিয়ার পক্ষে ছিলেন মেরকেল, করেছিলেন ন্যাটোতে ইউক্রেনের বিরোধিতাও