‘৫২ জন শহীদকে শিলংয়ের মাটিতে দাফন করেছি’
‘তখন ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের টিমের যারা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিক ছিলেন নীলকমল। একদিন রাত দুটার সময় হঠাৎ তিনি ফোন করলেন আমাকে, বড় সাহেব বলে ডাকতেন। বললেন, বড় সাহেব একটা কাজ করতে হবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন, তাকে মাটি দিতে হবে। তখন আমি বললাম ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আমার পূর্বপুরুষরা শিলংয়ে একটা মসজিদ তৈরি করেছিলেন। সেই মসজিদটা পুলিশ বাজারে আছে, এখনো আছে। বংশ পরস্পরায় আমরা সেই মসজিদের খাদেম। আমি বলেছিলাম কোনো সমস্যা নেই, ইমাম সাহেব এটা করে দেবেন। আমরা সেই মরদেহ নিয়ে মসজিদে গেলাম। মসজিদে মরদেহের বস্তা খুলে হতবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম ১২-১৩ বছরের একটা ছেলে বুকে গুলি লেগে মারা গেছে। তখন আমি এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে সেটা বলার নয়। আমরা কয়েকজন মিলে তাকে দাফন করেছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিচারণ করছিলেন ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনস্বীকার্য ভূমিকা রাখায় আহমেদ এবং তার ভাই আফজাল হোসেন ও বোন আশরাফী বেগমকে ২০১২ সালে সম্মাননা দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। শিলংয়ের একটি হোটেলে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে ভাই আফজালকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ৮৮ বছর বয়সী আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে এ স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসাম ও মেঘালয় সরকার। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম)।
আহমেদ হোসেন সেই বালক শহীদকে দাফনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, যখন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহের কথা শুনলাম, ভাবলাম মুক্তিযোদ্ধা হয়তো হবেন বিশালকায়-হাট্টাকাট্টা একজন কেউ, কিন্তু এ বালককে দেখতে পেয়ে পুরো হতবাক হয়ে পড়ি, এমন বাচ্চা ছেলেকেও ছাড়লো না? এভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি, আমার ভাই (আফজাল) ও আরও কয়েকজন মিলে ৫২ জন শহীদকে শিলংয়ের মাটিতে দাফন করেছি। নাম-পরিচয়হীন এ বীরশহীদরা শায়িত আছেন শিলং মওপ্রেম কবরস্থানে।
আরও পড়ুন>>> ‘কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ানোয় ভারতীয়দের কাছে চিরকৃতজ্ঞ বাংলাদেশ’
পেশায় একজন ফটোগ্রাফার আহমেদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ ছবি আছে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধসহ দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গার প্রায় ৩০ হাজার ছবির নেগেটিভ তার সংগ্রহে আছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদাররা বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার কিছুটা চিত্রও সেসব ছবিতে আছে।
আলোচনার ফাঁকে শমসের মবিন চৌধুরী এসব ছবি থেকে কিছু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য দিতে আহমেদ হোসেনের প্রতি আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধকালের লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-অনুভূতির স্মৃতিচারণ করে আহমেদ হোসেন বলেন, ঘটনাগুলো এত বিষাদময় ছিল যে, গোটা জীবনে বলে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সেসময় আমরা কয়েকজন (নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে) প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিটিং হতো। মিটিংগুলো সব আমাদের (শিলংয়ের) বাড়িতে হতো। তখন মিজানুর রহমান সাহেব, অগ্নিকন্যা যাকে বলা হয়, সেই মতিয়া চৌধুরীসহ অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেন। আমাদের বাড়িতে মিটিং হতো। আস্তে আস্তে কয়েস ভাই (কয়েস আহমেদ) আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিতে আরম্ভ করলেন। তখন আমরা প্রশিক্ষণে যেতাম, তুমা বলে একটা জায়গায় প্রশিক্ষণ হতো। বন্দুক ট্রেনিং, মেশিন গান ট্রেনিং। একদিন একটা ট্রেনিংয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন— আপনি ট্রেইনারের (প্রশিক্ষক) পাশে দাঁড়ান। আমি ট্রেইনারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আর বাকি ছেলেরা সব নিচে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে ট্রেইনারের কথা শুনতে। আচমকা সেই ট্রেইনার হঠাৎ মেশিনগান চালিয়ে দিলেন। আমি এত হতবাক হয়ে গেলাম যে বলার মতো না। তখন চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। ট্রেনিংয়ে সবাই বলতো, আমাকে কবে যুদ্ধে পাঠাবেন, কবে যুদ্ধে পাঠাবেন? তখন ট্রেইনার বললেন, আমরা এ সাতজনকেই (মেশিনগান চালানোর সময় উপস্থিত) শুধু পাঠাবো, অন্যদের যেতে হবে না।
আরও পড়ুন>> স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে আসামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিদল
কীভাবে কোথায় থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন তা বর্ণনা করে আহমেদ হোসেন বলেন, প্রথমে আমরা ডাউকি বাজারে (সিলেটের তামাবিলের বিপরীত পাশে) থাকতাম, জঙ্গলে থাকতাম। আমি বেসিকালি একজন ফটোজানালিস্ট। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কোনো রাজ্য আমার বাদ নেই ছবি তোলার। আমার নেগেটিভের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মুক্তিযুদ্ধের যে ছবিগুলো আছে সেই ছবিগুলো পাওয়া যাবে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং বেদনাময় ঘটনা ঘটেছে। সেসব দেখেছি।
শৈশবে ভারতের স্বাধীনতার সাক্ষী হলেও বিজয়ের আনন্দ ৭১ সালেই ছুঁয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ভারতের স্বাধীনতা খুব ছোটবেলায় দেখেছি। তখন বুঝতে পারিনি স্বাধীনতা কী ব্যাপার। কিন্তু যখন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেটে গিয়ে পৌঁছালাম, তখন প্রথমে সিলেটে আমাকে ঢুকতে দেয়নি। খাদিমনগরে (সিলেট সদরে) আটকে দিয়েছিল। বিএসএফের (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) একজন ছিলেন তখন কর্নেল গালিব, তাকে বললাম ভাই আমাকে তো যেতেই হবে। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের যে আনন্দ দেখেছি, তা কোনো দিন ভুলতে পারবো না।
স্মৃতিচারণকালে আক্ষেপ করে আহমেদ হোসেন বলেন, আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি, অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা দেখেছি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর কেউ জিজ্ঞেসও করেনি আপনারা কী করেছিলেন, কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন, সম্মানিতও করেছেন, এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে।
এইচএ/এমএএইচ/জেআইএম