করোনার উৎস সম্পর্কে মার্কিন প্রতিবেদনের ভিত্তি নেই: চীন
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। কিন্তু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উৎস কোথায় তা নিয়ে এখনও বিশেষজ্ঞরা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি। তবে চীনে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে চীনা ভাইরাস বলে ব্যাঙ্গ করেছেন। এমনকি তিনি বার বার চীনকেই এজন্য দোষারোপ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনও ট্রাম্পের দেখানো পথেই হাঁটছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সদস্যদের একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। সেখানেও চীনকেই দায়ী করা হয়েছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মা ঝাওশু একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে মা ঝাওশু বলেন, সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সদস্যরা কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে একটি তথাকথিত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি একটি মিথ্যা প্রতিবেদন। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। চীনের ওপর অপবাদ ও আক্রমণের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ওই বিবৃতি প্রকাশ করেছে বলে অভিযোগ করেছে বেইজিং।
এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে চীনের তীব্র আপত্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বেইজিং। চীনা উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় জোর দিয়ে বলেছি যে, করোনাভাইরাসের উৎস শনাক্ত করা একটি জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয় যা, যৌথ গবেষণার মাধ্যমে সারাবিশ্বের বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণে করা উচিত এবং একমাত্র এভাবেই তা সম্ভব।
কিন্তু বিজ্ঞান ও সত্যকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক কারসাজি এবং গোয়েন্দাদের দিয়ে উৎস খুঁজতে ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। কোনো প্রমাণ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র চীনের নামে অপপ্রচার এবং দোষারোপের উদ্দেশ্যে একের পর এক গল্প তৈরি করছে। তাদের উদ্দেশ্য কোভিডের উৎস খোঁজার নামে চীনের ওপর দোষ চাপানো এবং রাজনৈতিক ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া। কোভিডের উৎস খুঁজতে গোয়েন্দাদের নিযুক্ত করার বিষয়টি রাজনীতিকরণেরই সুস্পষ্ট প্রমাণ।
উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে চীনকে স্বচ্ছ বা সহযোগী না হওয়ার অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন বলছে, এটি নিছক অর্থহীন কথা। উৎস শনাক্তকরণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে সহযোগিতার ভিত্তিকে চীন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এ ধরণের সহযোগিতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তারা। স্বচ্ছ নীতির ভিত্তিতে করোনার উৎস শনাক্তকরণ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য দু’বার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞদের চীনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক এবং চীনা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ গবেষক দল চীনে ২৮ দিন গবেষণা চালিয়েছে এবং নির্ভরযোগ্য, পেশাদার ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি উৎস শনাক্তকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি অসাধারণ ভিত্তি। উৎস শনাক্তকরণে বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে আসছে চীন এবং এভাবেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এই বিষয়টিকে রাজনীতিকরণের প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করছে বেইজিং।
চীনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রই এই বিষয়ে স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল এবং সহযোগী ভূমিকা পালন করছে না। ফোর্ট ডেট্রিক বায়োল্যাব এবং দুইশো’রও বেশি বিদেশি ঘাটিতে জৈবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের জবাব দিতে যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে আসছে। তারা সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। সারাবিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে এর উত্তর দিতে হবে।
চীন বলছে, করোনাভাইরাসের উৎস শনাক্তের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা কোনো সমর্থন পায়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। ৮০টিরও বেশি দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালককে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাতে চিঠি লিখেছে, বিবৃতি দিয়েছে অথবা কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ গবেষক দলের যৌথ প্রতিবেদনকে সমর্থন জানিয়েছে। এছাড়া একশ’রও বেশি দেশ ও অঞ্চলের তিনশ’র বেশি রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সচিবালয়ে যৌথ বিবৃতি জমা দিয়েছে এবং ফোর্ট ডেট্রিক ঘাটির তদন্তের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি চীনা নেটিজেন একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
এগুলো মানুষের ন্যায়বিচারের পক্ষে সমর্থন বলে উল্লেখ করেছে বেইজিং। চীনা একটি প্রবাদ হলো, একটি ন্যায়সঙ্গত বিষয় প্রচুর সমর্থন পায় আর অন্যায্য বিষয় কম সমর্থন পায়। যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও সতর্ক করে তারা বলছে, উৎস শনাক্তকরণকে রাজনীতিকরণ কোনো ফলাফল এনে দেবে না। উৎস শনাক্তকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশকে বিষাক্ত করে অথবা বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংহতিকে অবমূল্যায়ন করে এমন কিছু করা অবিলম্বে বন্ধ করা এবং বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক উৎস শনাক্তকরণ ও সহযোগিতার সঠিক পথে ফিরে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
টিটিএন/এমএস