কয়েক দশকের চেষ্টায় পোলিওমুক্ত আফ্রিকা
মাত্র দুই যুগ আগেও এক লাখের কাছাকাছি পোলিও রোগী ছিল আফ্রিকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাসহ লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবকের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে মহাদেশটি থেকে নির্মূল হয়েছে আজীবনের পঙ্গুত্ব সৃষ্টিকারী ভাইরাসটি। চার বছর আগে আফ্রিকায় সবশেষ পোলিও রোগীর সন্ধান মিলেছিল নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে। এরপর আর নতুন কোনও সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। একারণে শিগগিরই গোটা মহাদেশটিকেই পোলিওমুক্ত ঘোষণা করতে যাচ্ছে আফ্রিকা রিজিওনাল সার্টিফিকেশন কমিশন (এআরসিসি)।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্যমতে, পোলিও রোগের জন্য দায়ী পোলিওভাইরাস তিন ধরনের- টাইপ ১, টাইপ ২, ও টাইপ ৩। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে টাইপ ২ পোলিওভাইরাস নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। সবশেষ ১৯৯৯ সালে ভারতে শনাক্ত হয়েছিল এটি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে নির্মূল ঘোষণা করা হয় টাইপ ৩ পোলিওভাইরাস। এর সবশেষ দেখা মিলেছিল ২০১২ সালের নভেম্বরে। বর্তমানে শুধু টাইপ ১ পোলিওভাইরাস দেখা যায়। এর সংক্রমণে মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, এমনকি কখনও কখনও এটি প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে।
সাফল্যের নেপথ্যে
আফ্রিকা মহাদেশ পোলিওমুক্ত হওয়ার সবশেষ অধ্যায়টি রচিত হয়েছে নাইজেরিয়ার বর্নো প্রদেশে। বিদ্রোহ-সহিংসতার মধ্যে অঞ্চলটিতে পোলিওর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষেই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
ডব্লিউএইচও’র আঞ্চলিক পরিচালক ডা. মাতশিদিসো মোয়েতি বলেন, এই মুহূর্তটি অসংখ্য মানুষের অবদান এবং আশ্চর্যজনক অধ্যবসায়ের ফল। আমরা এমনও মুহুর্তের মুখোমুখি হয়েছি যখন ভাবছি যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, তখনই আবার সব উল্টে গেছে।
তিনি জানান, আফ্রিকা থেকে পোলিও নির্মূলে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের কাজটি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর সঙ্গে ছিল ইউনিসেফ, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, সিডিসি এবং বিভিন্ন সরকার ও স্থানীয় নেতারা।
মোয়েতি বলেন, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি, ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহপ্রবণতার জেরে প্রাণঘাতী হামলা মোকাবিলা এবং কর্মসূচিতে পোলিও সারভাইভারদের (পোলিও আক্রান্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি) যুক্ত করা ভাইরাসটি নির্মূলে মূল ভূমিকা পালন করেছে।
যেভাবে নির্মূল হলো আফ্রিকার পোলিও
১৯৮৮ সালে বৈশ্বিক পোলিও নির্মূল কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয় এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই। এ উদ্যোগের ফলে নাটকীয়ভাবে ’৮৮ সালের প্রায় সাড়ে তিন লাখ পোলিও রোগীর সংখ্যা ২০১৮ সালে নেমে আসে মাত্র ৩৩ জনে। আফ্রিকা মহাদেশে পোলিও নির্মূল প্রচারণায় নেতৃত্ব দেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী জনপ্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
চ্যালেঞ্জ এসেছে একের পর এক
আফ্রিকায় ভাইরাস নির্মূলের অভিযান অতটা সহজ ছিল না কারও জন্যই। অন্যান্য দেশে কমলেও নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ায় আরও কঠিন হয়ে যায় এ কাজ। ২০১৩ সালে দেশটির কানো শহরে শিশুদের ভ্যাকসিন দেয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হয় নয়জন স্বাস্থ্যকর্মীকে। ধারণা করা হয়, এ হামলা চালিয়েছিল বোকো হারামের বন্দুকধারী সদস্যরা।
রোটারি ইন্টারন্যাশনালের নাইজেরিয়া শাখার প্রধান ডা. তুনজি ফুনশো জানান, অঞ্চলটিতে পোলিও নির্মূল কর্মূসূচিতে যুক্ত অন্তত ৬৭ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। হামলা বা অপহরণের শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণে অপরাগতার জেরেও বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
ডা. তুনজি বলেন, একটি বাজে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ নয়। এটি থেকে এইচআইভি, এইডস হতে পারে বা উত্তরাঞ্চলের জনসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে নারীদের বন্ধ্যা করতে পারে। এছাড়া, উদ্যোগটি পশ্চিমাদের সহযোগিতায় হওয়ায় তা নিয়ে অঞ্চলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে সন্দেহ ছড়িয়ে পড়েছিল।
২০০৩ সালের জুলাইয়ে নাইজেরিয়ার অন্তত পাঁচটি প্রদেশ পোলিও ভ্যাকসিন কর্মসূচি বন্ধ করে দেয় এবং এ অবস্থা অন্তত একবছর স্থায়ী ছিল। ফলে দেশটিতে পোলিও রোগীর সংখ্যা আবারও বেড়ে যায়, পাশাপাশি নাইজেরিয়া থেকে এ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে গোটা মহাদেশ জুড়েই। আফ্রিকায় অন্যান্য রোগের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের বিতর্কিত ইতিহাসও নাইজেরিয়ায় পোলিও ভ্যাকসিন বিরোধিতার পালে হাওয়া লাগায়।
তবে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় নেতাদের জোর প্রচেষ্টা এবং সরকারি প্রচারণা ও শহর শহরে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির মোড় ঘুরতে থাকে। ২০১৫ সালে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি নিজের নাতির মুখে ভ্যাকসিন দিয়ে পোলিওবিরোধী অভিযানে উৎসাহ দেন। সেসময় টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষকে এ ঘটনা দেখানো হয়।
আছে আরও কারণ
ডা. তুনজি ফুনশো বলেন, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, শুধু পোলিও ভ্যাকসিনে বিশ্বাস নেই বলেই তারা (নাইজেরীয় জনগণ) এটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল তা নয়… অন্য চাহিদা আগে আসছিল। যেমন, পোলিও ভ্যাকসিনের আগে ম্যালেরিয়ার মতো গুরুতর অসুখের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উঠে আসছিল। ফলে, পোলিও ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়ে উঠেছিল একধরনের সরকারবিরোধী প্রতিবাদ।
রোটারি ইন্টারন্যাশনালের এ কর্মকর্তা বলেন, অনেক বাবা সন্তানদের ভ্যাকসিন দিতে চাচ্ছিলেন না। কারণ তারা না খেয়ে রয়েছে এটি প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছিলেন।
সাফল্যের পরেও হতাশা
১৯৯৬ সালে আফ্রিকায় পোলিও আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণকারী শিশুর সংখ্যা ছিল অন্তত ৭৫ হাজার। এখন এসব পোলিও সারভাইভারের জীবনমানের উন্নয়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন ডা. মোয়েতি।
নাইজেরিয়ার পোলিও সারভাইভারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুসবাহু লাওয়ান দিদি বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগে আমাদের শুরু করা কাজে এমন ফলাফল এসেছে, এটি সত্যিই চমৎকার। পোলিও সারভাইভার হিসেবে আমরা খুবই খুশি। আমাদের বিশ্বাস, আমরাই এ দেশের সবশেষ পোলিও সারভাইভার হবো।
তবে তিনি বলেন, নাইজেরিয়ার পোলিও সারভাইভারদের মধ্যে ৯০ শতাংশই দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। আমাদের অনেকেই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। এমনটা হওয়া উচিত নয়।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
কেএএ/এমএস