করোনা : আসন্ন শীতকালে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে?
আর মাস তিনেকের মধ্যেই শীত আসছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এ সময়টায় ঠান্ডা লাগা বা ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ কারণে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, ঋতু পরিবর্তনের সময় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাবে এবং বলা হচ্ছে, প্রথম দফায় সংক্রমণ যত ব্যাপক ছিল—দ্বিতীয় দফায় তা আরও মারাত্মক হবে।
কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ কেমন চেহারা নেবে—তার পূর্বাভাস দেয়া কি এত সহজ-সরল? মোটেও তা নয়। বরং ব্যাপারটা বেশ জটিল। বিবিসির একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
শুধু করোনার প্রকৃতি নয়, অন্য নানা রকম শীতকালীন রোগজীবাণু, মানুষের আচরণ, সরকারী নীতির সাফল্য-ব্যর্থতা—এরকম অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে, করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসলেই আসবে কিনা।
তা ছাড়া বিজ্ঞানে এখন নতুন কিছু গবেষণা চলছে যাতে দেখা যায় যে, একটি ভাইরাল সংক্রমণ হয়তো অন্য কোনো ভাইরাসের সংক্রমণকে আটকে দিতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা এখনো অজানা।
করোনাভাইরাস কি শীতের সময় বেশি ছড়াবে?
এর উত্তর এখনও পাওয়া যায় নি। তবে বিজ্ঞানীরা বলেন, এমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এটা বলা হচ্ছে, অন্য ভাইরাস সম্পর্কে আমরা যা জানি তার ওপর ভিত্তি করে।
করোনাভাইরাস আছে মোট চার রকমের—যা সাধারণ সর্দিজ্বরের লক্ষণ সৃষ্টি করে। প্রতিটিই সহজে ছড়ায় শীতের সময়। ইনফ্লুয়েঞ্জা, রাইনোভাইরাস এবং আরএসভি নামে আরেকটি ভাইরাস—এর সবগুলোরই আচরণ মোটামুটি একই রকম।
তবে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ড. রেচেল লো বলছেন, ‘এগুলো হয়তো মৌসুমী হতে পারে, কারণ অন্য কিছু ভাইরাস আছে যেগুলো শীতকালে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়—কিন্তু আবহাওয়া নাকি মানুষের আচরণ, কোনটার প্রভাব এখানে বেশি এখনো তা বোঝার ক্ষমতা খুব সীমিত।’
তবে দেখা গেছে, মানবদেহের বাইরের পরিবেশ যখন ঠান্ডা তখন সব ভাইরাসই অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের জন্য বিশেষ করে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিশেষ অনুকুল বলে দেখা গেছে।
সূর্যের আলোয় যে অতিবেগুনি রশ্মি থাকে তা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। কিন্তু শীতের সময় অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণও কম থাকে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঠান্ডার সময় লোকে ঘরের ভেতরেই বেশি থাকে। দরজা জানালা থাকে বন্ধ থাকে। বাতাস চলাচল করে কম এবং এই পরিবেশই করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য সহায়ক।
ব্রিটেনের অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেস এর এক পূর্বাভাসমূলক রিপোর্ট বলছে, শীতের সময় ব্রিটেনের পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ হলে তাতে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাবে।
রিপোর্টে ধরে নেয়া হয়েছে, সে পরিস্থিতিতে ‘আর’ নম্বর হবে ১.৭ অর্থাৎ একজন সংক্রমিত ব্যক্তি আরো ১.৭ জনকে সংক্রমিত করবে। বর্তমানে ব্রিটেনে এই ‘আর’ নম্বর ১ এর নিচে। লকডাউনের আগে তা ছিল প্রায় ৩।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ওয়েন্ডি বার্কলি বলছেন, এখনো অনেক কিছুই অজানা, তবে লোকে যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে উদ্বিগ্ন তার সঙ্গত কারণ আছে এবং ব্রিটেনে একটা দ্বিতীয় ঢেউ আসা খুবই সম্ভব।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ব্রিটেনে জনসংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, ৯৫ শতাংশের ভাইরাস প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতাই নেই। এখানে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয়নি।
অন্য ভাইরাসগুলো কি সমস্যার কারণ হতে পারে?
যেটা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন তা হলো, করেনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবং নিয়মিত শীতকালীন ফ্লু দুটো যদি একসঙ্গে হয় তাহলে কি হবে? এটা ঠিক যে করোনার কারণে মানুষের আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ ঘন ঘন হাত ধুচ্ছে, মুখে মাস্ক পরছে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করছে, বাড়িতে বসে কাজ করছে।
তাই এমন হতে পারে যে আসন্ন শীতে নিয়মিত ফ্লু ভাইরাসও হয়তো বেশি ছড়াতে পারবে না। অস্ট্রেলিয়াতে এখন শীত চলছে। সেখানে ঠিক এই ব্যাপারটাই দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের সময় সেখানে শীতকালীন ফ্লু প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। চিলি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দক্ষিণ গোলার্ধের দেশেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
তারপরও ড. লো বলছেন, আসন্ন শীতকালে করোনাভাইরাসের একটা দ্বিতীয় ঢেউএর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে চলবে না।
একটি ভাইরাস কি আরেকটিকে ঠেকিয়ে দিতে পারে?
এটা হচ্ছে বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে বড় কৌতুহলের ব্যাপার যে সার্স-কভ-২ (করোনাভাইরাসের পোশাকি নাম) ভাইরাসটি অন্য ভাইরাসের সাথে কি আচরণ করে।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টিকারী সব ভাইরাসই মানবদেহের একটি জায়গাতেই সংক্রমণ ঘটায়, আর তা হলো, মানুষের নাক, গলা ও ফুসফুসের ভেতরের কোষগুলো। এ কারণেই ভাইরাসগুলোর মধ্যে জায়গা দখলের লড়াই শুরু হতে পারে।
বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে যে, এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ অন্য আরেকটি ভাইরাসকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ইউরোপে রাইনোভাইরাস সংক্রমণের কারণেই ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ বিলম্বিত হয়েছিল।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস গবেষণা কেন্দ্রের ড. পাবলো মারসিয়া বলছেন, একটি ভাইরাসের আক্রমণের ফলে মানবদেহে যে রোগ প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া হয় তা অন্য কিছু ভাইরাসকে অন্তত খানিকটা সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পারে।
তবে অন্য কয়েকটি জরিপে আবার দেখা গেছে যে কিছু কিছু ভাইরাস বেশ ‘মিলেমিশে’ থাকতে পারে এবং পাশাপাশি বিস্তার ঘটাতে পারে।
প্রশ্ন হলো: করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ এর বেলায় কী ঘটবে?
ড. মারসিয়া বলছেন, ‘আমাদের উপাত্তে দেখা যায় যে মিশ্র সংক্রমণের ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়ানোর দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। কাজেই আমার মনে হয় একই সাথে সার্স-কোভ-২ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়াচ্ছে এমনটা হয়তো আমরা খুব বেশি দেখতে পাবো না।’
একসঙ্গে দুটি ভাইরাসেই সংক্রমিত হয়েছেন এমন লোক পাওয়া গেছে খুবই কম। তবে যখন এটা ঘটেছে— তখন দেখা গেছে উপসর্গ ছিল অনেক বেশি গুরুতর।
তবে ড. মারসিয়া বলছেন, অন্য কিছু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা গেছে যে তারা আরএসভি, এডেনোভাইরাস এবং কিছু প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জার সাথে একই সময়ে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। আমি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে আছি। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসএ/পিআর