করোনায় মৃত্যু নেই, বিশ্ববাসীর ‘কুর্নিশ’ পাচ্ছে ভিয়েতনাম
করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে যেখানে লন্ডভন্ড ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত দেশগুলো; সেখানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল একটি দেশ এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে শক্তভাবে। বলা হচ্ছে ১০ কোটি জনসংখ্যার ভিয়েতনামের কথা। চীনের সীমান্তবর্তী দেশটিতে জানুয়ারিতেই ধরা পড়েছিল করোনার সংক্রমণ। তবে আশ্চর্যজনকভাবে চারমাস পরেও সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৭০। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন ২১০ জনই। তারচেয়ে বড় খবর, ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত একজনও করোনাভাইরাসে মারা যাননি।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনে প্রথমবার ধরা পড়ে নভেল করোনাভাইরাস। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্তত ১৮৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। প্রাণ কেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের। সেই চীনের সঙ্গেই প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত ভিয়েতনামের। দুই দেশের মধ্যে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে হাজার হাজার মানুষ। তারপরও করোনার প্রকোপ একেবারেই সামান্য ভিয়েতনামে। কীভাবে তারা এ সাফল্য দেখাল তা এখন সারা কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ভিয়েতনামের সাফল্যের নেপথ্যে
দেশটিতে করোনাভাইরাস খুব একটা না ছড়ালেও এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে অন্তত আড়াই লাখ। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষকে। ফেব্রুয়ারিতেই করোনা সংকটকে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ঘোষণা করে দেশটির সরকার। গত ১৭ মার্চ থেকে সেখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাস্কের দাম বাড়ালে বড় শাস্তিরও ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় মাস্কের ‘ফ্রি বুথ' চালু করে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় গত মার্চ থেকে দেশে প্রবেশকারীদের আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করে ভিয়েতনাম। বিদেশিদের প্রবেশে দেয়া হয় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা। বেশ কয়েকটি হোটেল ও সামরিক ছাউনিকে অস্থায়ী হাসপাতাল বা আশ্রয়কেন্দ্র পরিণত করা হয়। বিমানের সব যাত্রীকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়। এছাড়া, বিমানবন্দরে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সরকার।
কোনও এলাকায় ভাইরাস সংক্রমণের খবর পেলেই গোটা এলাকা লকডাউন করে গণহারে পরীক্ষা করেছে ভিয়েতনাম। গত ফেব্রুয়ারিতে সন-লই নামে একটি গ্রামে কয়েকজনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। তখন প্রায় ১০ হাজার মানুষের পুরো এলাকাটি ২০ দিনের জন্য লকডাউন করে সবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
ফার্মেসিগুলো থেকে কে কী ওষুধ কিনেছে সেই তথ্যও সংগ্রহ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এই সূত্র ধরেও অনেকের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত মাসে করোনাকে 'জাতীয় মহামারি' বলে ঘোষণা করেছে ভিয়েতনাম সরকার।
করোনাযুদ্ধে ভিয়েতনামের আরেকটি বড় সাফল্য হলো 'টেস্ট কিট' তৈরি। গত জানুয়ারিতেও তারা কোরিয়া থেকে কিট আমদানি করেছিল। অথচ এপ্রিলে এসে তারাই কিট নিয়ে নিজস্ব গবেষণা ও উৎপাদন শেষে সেগুলো প্রায় ২০টি দেশে রপ্তানি করছে। ইতোমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিয়েতনামি কিটের স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কিট নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চিকিৎসক-নার্সদের মধ্যে করোনার ঝুঁকি কমাতে হাসপাতালে রোবট ব্যবহার করেছে ভিয়েতনাম। মেডিকেল কর্মীদের সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিনশ’র কম হলেও অন্তত ১০ হাজার রোগীর চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ ও সরঞ্জাম মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ভিয়েতনাম সরকার। এছাড়া, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা প্রতিরোধে এখনই তারা জাতীয় মহামারির সতর্কতা প্রত্যাহার না করার ঘোষণা দিয়েছে।
২০০৩ সালের সার্স মহামারির সময়ও এশিয়ার মধ্যে ভিয়েতনামই প্রথম নিজেকে ভাইরাসমুক্ত ঘোষণা করেছিল। তারা এবারও প্রমাণ করছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব উন্নত না হলেও কার্যকর নীতি ও এর সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে করোনাযুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়।
কেএএ/জেআইএম