জন্মের পর ১০ দিন সন্তানের কাছেও যেতে পারলেন না মা
সৃষ্টিকর্তা তার কোলজুড়ে দিয়েছেন এক পুত্র সন্তান। অথচ কলিজার টুকরা সেই সন্তানকে এখনও পর্যন্ত খালি হাতে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে পারেননি ওই মা। গ্লাভস পরেই প্রিয় সন্তানের গায়ে হাত বুলাতে হচ্ছে। নিজের ঠোঁটের সঙ্গে এখনও নাড়িছেঁড়া ধনের ঠোটের মিলন হয়নি; মাস্ক পরেই সন্তানের ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দিতে হচ্ছে মাকে।
এ অবর্ণনীয় কষ্ট এক স্প্যানিশ মায়ের। নিজের শরীরে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সন্তান জন্ম দিয়েই ওই মাকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়েছে। জন্মের পরপরই চিকিৎসকরা নবজাতককে যেভাবে মায়ের বুকের ওপর শুইয়ে দেন, তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ওই মা। সন্তান ছিল ইনকিউবেটরে আর মা ছিলেন বাড়িতে!
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জানায়, স্প্যানিশ ওই মায়ের নাম ভেনেসা মুরো (৩৪)। ১৩ মার্চ সিজারের মাধ্যমে ছেলে অলিভারের জন্ম হয়। সন্তান জন্মের আগে শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ায় সন্তান জন্ম দিয়েই তাকে ও তার স্বামীকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যেতে হয়। তাদের মাধ্যমে যাতে নবজাতকের শরীরে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য তাকে পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
বিশ্বের ২০৪টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে বিশ্বে ৫৩ হাজার ১৫৮ জন মারা গেছে। মোট আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৩৮৬ জন। সুস্থ হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ১৮ জন।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে স্পেনে, এক লাখ ১৭ হাজার ৭১০ জন। মৃতের দিক দিয়েও ইতালির পর স্পেনের অবস্থান। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৯৩৫ জন মারা গেছেন, যেখানে ইতালিতে ১৩ হাজার ৯১৫ (সর্বোচ্চ)।
ভেনেসার সিজারিয়ান ডেট ছিল ১৬ মার্চ। তবে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায় তার দাদির শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়লে। পরে ওই রোগে তার মৃত্যুও হয়। মার্চ ১২ তারিখে তার ও তার স্বীমার শরীরেও প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উপস্থিতি মেলে। পরের দিন ১৩ মার্চ চিকিৎসকরা তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘ ৯০ মিনিট অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) থাকার পর পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখ অভিভার।
এরপরই শুরু হয় বিচ্ছেদের পালা। শিশু অলিভারকে করোনা থেকে নিরাপদ রাখতে অপারেশনের পর সোজা রাখা হয় ইনকিউবেটরে। তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে সেখানেই রাখা হয়। আর মাকে পাঠানো হয় বাড়িতে, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য।
১০ দিন পর সন্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান এই দম্পতি এবং হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরেই কেবল সন্তানকে বাড়িতে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
ইতোমধ্যে কোয়ারেন্টাইনে ১৪ দিন পার করেছেন এই দম্পতি। তবে টেস্টিং কিটের অভাবে তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা এখন করোনামুক্ত কিনা। এজন্য এখনও গ্লাভস ও মাস্ক পরেই অলিভারের সান্নিধ্যে থাকতে হচ্ছে তাদের।
এএফপি জানায়, দীর্ঘদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর মুরো যখন প্রথমবারের মতো তার সন্তানের সঙ্গে মিলিত হন তখন তার মুখ থেকে যে কথাটি প্রথম বের হয়েছিল তা হলো-‘ওহে খুদে চ্যাম্পিয়ন, আমরা এখন বাড়িতে যাচ্ছি।’
মুরো তার সেই অনুভূতি প্রসঙ্গে এএফপি বলেন, ‘আমি যখন তার সঙ্গে প্রথম মিলিত হলাম, তখন মনে হয়েছিল ও বোধহয় আজকেই জন্ম নিল।’
অলিভার যে হাসপাতালে জন্ম নেয়, ওই হাসপাতালের সাইকোলজিস্ট আরান্তজা ফার্নান্দেজ। ওই দিনের স্মৃতি প্রসঙ্গে এএফপিকে তিনি বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনা ছিল আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে দারুণ মুহূর্ত।’
স্পেনের এই দম্পতি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় অলিভারের নিয়মিত ছবি ও ভিডিও পাঠাতেন ফার্নান্দেজ, যা এই দম্পতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
স্ত্রী ভেনেসা মুরোর সঙ্গে এই কষ্টের ভাগিদার স্বামী ক্যারিলিও। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও আমার ছেলেকে গ্লাভস ছাড়া স্পর্শ করতে পারি না…আমার সেই দিনের অপেক্ষায় আছি কখন তাকে সরাসরি স্পর্শ করতে পারব, চুম্বন দিতে পারব।’
মাদ্রিদের যেখানে মুরো থাকেন, তার কিছু দূরেই তার বাবা-মার বাড়ি। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেই স্বল্প দূরত্বও এখন কয়েক মাইল মনে হয় মুরোর কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যে সময়টা পার করছি তা অত্যন্ত কঠিন সময়। তারপরও আমাদের এটা মানিয়ে নিতে হবে।’
এক মাস হতে আর বেশি দেরি নেই অলিভারের। তবে স্প্যানিশ এই মায়ের ধারণা, ‘সে খুব শিগগিরই তাদের সঙ্গে মাদ্রিদের রাস্তায় বের হতে পারবে। সে জানতে পারবে কে তার দাদা-দাদি, চাচা-চাচি। তবে তাদের সঙ্গে যা ঘটে গেছে তা স্মৃতিতে দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।’
এসআর/জেআইএম