দিল্লির দাঙ্গা করোনাভাইরাসের ‘ভারতীয় ভার্সন’: অরুন্ধতী রায়
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি-কে (এনআরসি) ঘিরে উত্তাল ভারত। এই দুটি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লির উত্তরাঞ্চলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে হামলা চালায় ক্ষমতাসীন বিজেপির মদতপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। বেঁধে যায় দাঙ্গা। ওই দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত ৪৩ জন। আহত হয়েছেন আড়াইশ জনের বেশি মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মতো পরিণত হয়েছে দাঙ্গাকবলিত উত্তর-পূর্ব দিল্লি। এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্তাদের অভিযুক্ত করছেন ভারতের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
রোববার (১ মার্চ) নয়াদিল্লির জন্তর মন্তরে এক নাগরিক সমাবেশে বক্তৃতা করেন প্রখ্যাত লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতী রায়। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্টবাদী হিসেবে সুপরিচিত অরুন্ধতী দিল্লিতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিপীড়নে মৌলবাদী হিন্দুদের বাঁধানো দাঙ্গাকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ‘ভারতীয় ভার্সন’ বলে মন্তব্য করেন। ওই সমাবেশে তার বক্তব্যের সংক্ষেপিত অংশ তুলে ধরা হলো।
“আজ আমরা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখান থেকে খানিকটা দূরে চারদিন আগে ফ্যাসিবাদী গুন্ডারা সশস্ত্র ও খুনে হামলা চালিয়েছে শ্রমজীবী মুসলিমদের জনপদে। ক্ষমতাসীন নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য, পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতা, গণমাধ্যমের বিশাল একটি অংশের সার্বক্ষণিক সহযোগিতার আশ্বাস এবং এই অপরাধযজ্ঞে আদালতও বাধা দেবে না— এমন বিশ্বাস থেকেই তারা এ ধরনের তাণ্ডব চালিয়েছে।
দাঙ্গা বাঁধিয়ে এক মুসলিম যুবককে পেটাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা, ২৪ ফেব্রুয়ারির ছবি
দোকানপাট, ঘরবাড়ি, মসজিদ, যানবাহন- সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো এলাকা বিপর্যস্ত। হাসপাতালগুলো আহত ও সংকটাপন্ন মানুষে ভর্তি। মর্গ ভরে গেছে লাশে। দু’পক্ষের মানুষ মরলেও সংঘাত যে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানধারী গুন্ডারা শুরু করেছে তাতে কারও সন্দেহ নেই এবং এটা যে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থনে হয়েছে তাও স্পষ্ট। এটাকে আসলে কেবল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলা যায় না। ফ্যাসিবাদী ও ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে যে লড়াই চলছে, তার প্রকাশ এটি। ফ্যাসিবাদীদের প্রধান ‘শত্রু’ হিসেবেই মুসলিমরা এর শিকার হয়েছে। এটাকে রায়ট অথবা দাঙ্গা বলা, বাম বনাম ডানের লড়াই বলাও বিপজ্জনক এবং বিভ্রান্তিকর।
আমরা সবাই ভিডিও ফুটেজে দেখেছি, কীভাবে পুলিশ নীরব থেকেছে এবং কোনো কোনো সময় দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে মিলে কীভাবে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে। আমরা দেখেছি, কীভাবে নিজেদের অপরাধ লুকাতে তারা সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, কীভাবে পুলিশ আধমরা মুসলিম ছেলেদের নির্দয়ভাবে পেটাতে পেটাতে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য করেছে। সেই ছেলেদের একজন যে মারাও গেছে, আমরা সেটাও জানি। নিহত, আহত এবং নিঃস্ব, হিন্দু হোক বা মুসলিম, সবাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনের ‘ভিকটিম’ (শিকার), যার ফ্যাসিবাদের মুখোশ খসে পড়েছে জাতির সামনে। আসলে ১৮ বছর আগে এক রাজ্যে সপ্তাহব্যাপী গণহত্যার (গুজরাট দাঙ্গা) মূল হোতা যিনি ছিলেন, তার জন্য এটা নতুন কিছু নয়।
গতকাল উত্তর দিল্লিতে নতুন করে আর কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও কেন্দ্রীয় দিল্লিতে এক সমাবেশে আমরা শুনলাম স্লোগান দেয়া হচ্ছে, ‘দেশ কে গাদ্দারো কো গুলি মারো সালো কো’ (দেশদ্রোহীদের গুলি মারো)।
এই স্লোগান দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে যিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন এবং যাকে এই দাঙ্গার উসকানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, বিজেপির সেই নেতা কপিল মিশ্রর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় হাইকোর্টের বিচারপতি মুরালিধরন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আর এই ক্ষোভ প্রকাশ করতেই তাকে বদলি করা হয়। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্র তার চেহারা আর লুকাতে পারলো না। বিচারপতিদের নিয়ে এভাবে খেলা এটাই প্রথম নয়। গুজরাট দাঙ্গার পরও ৯৬ মুসলিমকে নিধনে দোষীসাব্যস্ত বাবু বজরঙ্গিকে ছাড়াতে আমরা নানা নাটকীয়তা দেখেছি। ইউটিউবে সার্চ দিলেই ‘নরেন্দ্র ভাই’র সেসব কীর্তি মিলবে।
সিএএবিরোধী এক সমাবেশে মানবাধিকারকর্মী ও বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতী রায়
নির্বাচনের পর এ ধরনের গণহত্যা হতে পারে বলে আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে। ভোট আদায়ের জন্য এটা বর্বরতম প্রচারণার অংশ হয়ে উঠেছে। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-আরএসএসের জোটের ভরাডুবির পর এই গণহত্যা চালানো হলো। অর্থাৎ এটি ভোট না দেয়া দিল্লিবাসীকে শাস্তি। একইসঙ্গে আসন্ন বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু ভোটারদের প্রতি তাদের সতর্কবার্তা।
সবকিছুই রেকর্ড হচ্ছে। সবকিছুই এখন সবাই দেখতে পারছে এবং শুনতে পারছে। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, পর্বেশ বার্মা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে কী ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন তা-ও মুঠোফোনের এক ক্লিকেই মিলছে।
…এ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন স্পষ্টতই মুসলিমবিদ্বেষী এবং অনেকক্ষেত্রে ভারতীয়-বিরোধী। মানুষের সব অধিকার নির্ভর করে তার নাগরিকত্বের ওপর। আপনি যখন তার নাগরিকত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবেন, তখন তার সন্তানের অধিকার, তার ভোটের অধিকার, তার ভূমির অধিকার, সব অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই ফেলে দেয়া হয়েছে ভারতবর্ষকে।
এই সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতের মানুষকে বিভাজন এবং তাদের অস্থিরতার মধ্যে ফেলা। এটা শুধু ভারতে নয়, গোটা উপমহাদেশে প্রভাব ফেলবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে লাখ লাখ মানুষকে ‘বাংলাদেশি উইপোকা’ বলে দাবি করেছেন, সেই মানুষদের বন্দিশালায়ও আটকে রাখা যাবে না, তাদের প্রত্যাবাসিতও করা যাবে না। বরং এ ধরনের ‘টার্ম’ ব্যবহার করে এবং এ ধরনের পরিহাসমূলক চিন্তা থেকে যা করা হচ্ছে, তার মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বসবাসরত লাখ লাখ হিন্দুকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। নয়াদিল্লির এমন ধর্মান্ধতার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে পারে তারা।
…সংবিধান লঙ্ঘন করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (স্বায়ত্তশাসন) কেড়ে নেয়ার ২১০তম দিন আজ। তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ হাজারও কাশ্মীরীকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ৭০ লাখ মানুষকে ইন্টারনেট-সেবা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, যা তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির দাঙ্গাকবলিত এলাকার রাস্তাগুলো শ্রীনগরের রাস্তার মতো দেখা যায়। সেদিন কাশ্মীরী শিশুরা সাত মাসের মধ্যে প্রথম স্কুলে যায়। কিন্তু যখন আপনার সবকিছুরই টুঁটি চেপে ধরা হবে, তখন স্কুলে যাওয়ার কোনো অর্থ থাকে?
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চারমুখ অরুন্ধতী রায়
যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয় না এবং যার প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তঃসারশূন্য হয়ে যায়, সেটি কেবল একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রই (সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্ববাদ) হতে পারে। সংবিধানের কোনো অংশের সঙ্গে অথবা গোটা সংবিধানের সঙ্গেও আপনার মত-দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু এটি যেন একেবারেই নেই, সেভাবে এই সরকারের মতো কর্মকাণ্ড চালানোর অর্থ আপনি গণতন্ত্রকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। সম্ভবত এটাই তাদের লক্ষ্য। এটাই করোনাভাইরাসের আমাদের ভার্সন। আমরা আসলে অসুস্থ।
কোনো দিক থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। কোনো প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্রও নয়, জাতিসংঘও নয়। এমনকি ভোটে জিততে চাওয়া কোনো রাজনৈতিক দলও নৈতিক অবস্থান নিতে পারে না, কারণ এখানে গোড়াতেই গলদ। পুরো সিস্টেম ভেঙে পড়েছে।
এখন আমাদের দরকার এমন মানুষ যারা অনেকের চোখে খারাপ হয়ে যেতে প্রস্তুত। যারা বিপদেও লড়াইয়ে প্রস্তুত। যারা সত্য বলতে প্রস্তুত। আমাদের দরকার সাহসী সাংবাদিক, সাহসী আইনজীবী, সাহসী শিল্পী, মেধাবী ও সাহসী লেখক, কবি, সংগীতজ্ঞ, চিত্রকর ও নির্মাতা। আমাদের অনেক কাজ বাকি, আমাদের বিশ্বজয় করতে হবে।”
এইচএ/এমএআর/এমকেএইচ