করোনাভাইরাস পরিস্থিতি চীনের চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে উ. কোরিয়ায়?
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিবেশি উত্তর কোরিয়ায় এই ভাইরাসে একজন আক্রান্তও পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র এই দেশটি সম্ভবত সংক্রমণ শনাক্ত করতে পারছে না; যেখানে প্রাদুর্ভাব শুরু হলে তা চীনের চেয়েও ভয়াবহ প্রাণঘাতী হতে পারে।
কোভিড-১৯ নামের এই ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৭৬৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন, মারা গেছেন কম ২ হাজার ১২৯ জন। পিয়ংইয়ংয়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশি দক্ষিণ কোরিয়া-সহ বিশ্বের দুই ডজনের বেশি দেশে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমিত হয়েছেন ১০৪ জন।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সরকারি মুখপত্র দৈনিক সিনমুন মঙ্গলবার দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলছে, আড়াই কোটি মানুষের এই দেশটিতে এখনও করোনাভাইরাসে কাউকে পাওয়া যায়নি। একই দিনে উত্তর কোরিয়ার এই বিবৃতিতে সমর্থন জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, উত্তর কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের কোনও আলামত নেই।
এদিকে, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে দেখা গেছে, দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা জনসমাগমপূর্ণ এলাকাগুলোকে সংক্রমণমুক্ত করছেন এবং এই ভাইরাসের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের সঙ্গে সব ধরনের বিমান ও ট্রেন চলাচল স্থগিত করেছে। এমনকি দেশটির রাজধানীতে আসা যেকোনও নাগরিক, সব বিদেশি, কূটনৈতিক কর্মকর্তা, কর্মচারী-সহ দাতব্য সংস্থার কর্মীদের শরীর স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ ১৪ দিন করা হলেও কোরীয় দ্বীপের এই দেশটি তা বাড়িয়ে করেছে একমাস।
চীন সীমান্তের এই দেশটি করোনার বিস্তার ঠেকাতে সামরিক আইন জারি করেছে। কারও শরীরে করোনার উপস্থিতি না পাওয়া গেলেও চীনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অথবা সম্প্রতি চীন ভ্রমণ করেছেন; এমন যেকোনও ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কিম জং উন।
শীর্ষ নেতার এমন নির্দেশ যারা অমান্য করবেন; বিশেষ করে অনুমোদন ছাড়া কোয়ারেন্টাইন থেকে বের হলে যে কাউকে সামরিক আইনে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে ডিক্রি জারি করা হয়েছে উত্তর কোরিয়ায়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার দৈনিক ডং-এ ইলবো এক প্রতিবেদনে বলছে, গণ-শৌচাগারে যাওয়ার কারণে সন্দেহভাজন করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পিয়ংইয়ংয়ের বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হয়ে থাকে চীনের সঙ্গে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর দেশটির সঙ্গে দেড় হাজার কিলোমিটারের সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। সংক্রমণ শনাক্ত করতে চীন সীমান্ত এলাকায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক পাঠিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস।
এতসব আয়োজন সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গণমাধ্যম বলছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ নিয়ে উত্তর কোরিয়ায় গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন মারা গেছে। তবে উত্তর কোরিয়ায় করোনায় প্রাণহানির এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি দক্ষিণের ওই গণমাধ্যম। উত্তর কোরিয়ায় গণমাধ্যম ও মানুষের বাকস্বাধীনতা ব্যাপক নিয়ন্ত্রিত।
উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা চীনের দুটি প্রদেশে দুই শতাধিক মানুষকে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এমনকি আত্মীয়-স্বজন চীনে থাকায় অনেক কোরীয় হর-হামেশাই বৈধ অথবা অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পেরিয়ে দেশটিতে যান। বেইজিংয়ের ধীরগতির সতর্কতার কারণে উত্তর কোরিয়ায় এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে থাকতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
হংকংয়ের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও এশিয়ার স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নিকোলাস ডেভিড থমাস বলেন, উত্তর কোরিয়া এবং চীন সীমান্তে শক্তিশালী চোরাচালান নেটওয়ার্ক রয়েছে। সুতরাং শুধুমাত্র একজন চোরাচালানকারীর শরীরে করোনার প্রবেশই যথেষ্ট...আর এটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যাবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ায় যদি এই ভাইরাস একবার পা রাখতে পারে তাহলে এটি দেশটিতে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ দেশটির স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা একেবারে দুর্বল। এ ধরনের ঘটনা দারিদ্রতা ও অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা একটি দেশের মানুষের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হেলথ কেয়ার সেন্টারের পরিচালক ডা. জন লিন্টন বলেন, উত্তর কোরিয়ায় যদি করোনাভাইরাস পৌঁছায়, যেখানে অন্যান্য অনেক অপ্রতুলতা এবং স্বাস্থ্যসেবার সঙ্কট রয়েছে; সেখানে মৃত্যুর হার কিছুটা বেশি হবে।
‘উত্তর কোরিয়ার সাধারণ জনগণ অপুষ্টিতে ভুগছে। তার ওপর এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তা চীনের চেয়েও বেশি প্রাণঘাতী হবে।’
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ (এক কোটি ১০ লাখ) পুষ্টিহীনতার শিকার এবং ব্যাপক পরিসরে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। এমনকি অনেক প্রদেশে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট রয়েছে।
২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচক প্রকাশ করে। বিশ্বের ১৯৫টি দেশের এই তালিকায় স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা নিয়ে ১৯৩তম অবস্থানে ছিল উত্তর কোরিয়া।
এমন প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে উত্তর কোরিয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লিন্টন, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার ভেতরে দাতব্য কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে বেশ কিছু হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন ডা. জন লিন্টন। সেখানে তিনি দেখেছেন, চিকিৎসকরা গ্লাভস পুনরায় ব্যবহারের জন্য বেটাডিনে ডুবিয়ে রাখছেন।
সিউলের ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিট বিভাগের চেয়ারম্যান ও জাতিসংঘের উন্নয়নবিষয়ক কর্মসূচি ইউএনডিপির সাবে পরিচালক ডা. মিয়াং-কেন লি বলেন, দেশটির রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে স্বাস্থ্যসেবা তুলনামূলক ভালো। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় এই ব্যবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ।
গত জানুয়ারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি মানুষের শরীর পরীক্ষা করা হলেও কারও শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পিয়ংইয়ং। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাস শনাক্ত করার মতো সক্ষমতাই নেই উত্তর কোরিয়া। যে কারণে প্রাদুর্ভাব শুরু হলে তা প্রাণহানির সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স, এএফপি।
এসআইএস/জেআইএম