করোনাভাইরাসে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি
চীনে সরকারি হিসাব অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যা বলা হচ্ছে তার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করেছেন উহানের হাসপাতালের এক কর্মী। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তার আগেই মৃত্যু হওয়ায় তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলা হচ্ছে না।
ফলে প্রকৃতপক্ষে যে পরিমাণ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তার সংখ্যা বেশি। জেইসি লুও (ছদ্মনাম) নামের এক হাসপাতাল কর্মী বলেন, কর্মকর্তারা যে তথ্য জানাচ্ছেন তার চেয়ে প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি।
এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কি-না সে বিষয়টি অনেকেই এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার লম্বা লাইনের কারণে বেশ সময় লাগছে। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন এমন অনেকেরই এই ভাইরাসে আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
চীনে সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ২৪ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫২২ জনই করোনাভাইরাসের উৎসস্থল হুবেই প্রদেশ বা এর আশপাশের বাসিন্দা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি।
দু'সপ্তাহ আগে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে এক চিকিৎসা কর্মীকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, উহানে ৯০ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। নিউক্লেরিক অ্যাসিড টেস্টের (এনএটি) মাধ্যমে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। জেইসি লুও সতর্ক করে বলেছেন, প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রকৃতপক্ষে আক্রান্তের সংখ্যা কত তা নির্ধারণ করাও যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার লম্বা লাইন পড়ে গেছে। এই তালিকা এত দীর্ঘ যে অনেকেই পরীক্ষা না করেই চলে যাচ্ছেন। ফলে কেউ আক্রান্ত হলেও সঠিক সময়ে তার চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই মুহূর্তে চিকিৎসকরা নির্ধারিত কিছু ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা চালাচ্ছেন এবং রোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের বাড়িতে গিয়ে পুরোপুরি আলাদাভাবে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জেইসি লুও বলেন, ওয়েটিং রুমগুলোতে পা রাখারও জায়গা নেই। এখানে অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত। আবার অনেকেই জানেন না যে তারা আক্রান্ত কি-না। ফলে ভাইরাসে আক্রান্তের বিষয়টি পরীক্ষা করতে এসে অসুস্থ লোকজনের সংস্পর্শে সুস্থ ব্যক্তিদেরও এই ভাইরাসে আক্রান্তের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, চীনের জরুরি ফোনকল সার্ভিস সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকছে। ট্যাক্সির সংকটের কারণে অনেকেই হেঁটেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতি দুটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করেছে চীন। ওই হাসপাতালগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের স্থানান্তর করা হচ্ছে। তবে ওই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টাফের সংকটের কারণে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ বেলজিয়ামে একজনের এই ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। মহামারির আশঙ্কায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই চীন থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া এ ভাইরাস ঠেকাতে চীন-ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ।
ফিলিপাইনসহ অনেক দেশই ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে চীন থেকে আগতদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলো চীনগামী ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীন।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ কী?
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগে। তবে এসব লক্ষণ মূলত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই জানা গেছে।
সেক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কি-না তা এখনও অজানা। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসের নাম দিয়েছে ২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে একদিনেই আরও ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে চীনের মূল ভূখণ্ড ও এর বাইরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯২ জন। মঙ্গলবার চীনে নতুন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৩ হাজার ৮৮৭ জন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত চীনে প্রতিষেধকবিহীন এই ভাইরাসে ২৪ হাজার ৩২৪ জন আক্রান্ত হয়েছে।
চীনের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে এখন পর্যন্ত মারা গেছে অন্তত দুইজন। মঙ্গলবার হংকংয়ে ৩৯ বছর বয়সী এক ব্যক্তি প্রাণ হারান। তিনি কিছুদিন আগেই করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ফিরেছিলেন। এর আগে, গত সপ্তাহে ফিলিপাইনে মারা যান উহানফেরত আরও একজন।
টিটিএন/পিআর