ট্রাম্পের ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ সম্পর্কে যা জানা গেল
আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসানের লক্ষ্যে দুই বছরেরও বেশি সময় আগে তার প্রশাসন এ চুক্তির খসড়া তৈরির কাজ শুরু করে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি প্রকাশ করছে।
ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী এ প্রস্তাবনা উন্মোচন করার কথা শোনা গেলেও অনেকবার তা বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি ট্রাম্প প্রশাসন কথিত এ মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার বেশিরভাগ বিষয় সম্পর্কে মানুষকে আন্দাজ করারও সুযোগ দেয়নি। এখন পর্যন্ত এ চুক্তি নিয়ে যা জানা গেছে তা আল জাজিরা প্রকাশ করেছে।
যে সময়ে চুক্তিটি প্রকাশ পাচ্ছে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গান্টজের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠকের আগেই এ পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন বলে নিজেই জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আগামীকাল তিনি ইসরায়েলের ওই নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
কথিত এই শান্তি চুক্তি ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। এছাড়া তাদের হোয়াইট হাউসে বৈঠকের আমন্ত্রণও জানায়নি ওয়াশিংটন। ট্রাম্প বলছেন, ‘এটা একটা দারুণ পরিকল্পনা। আমি চুক্তি করতে ভালোবাসি। সবাই বলেন ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা যেকোনো কঠিন চুক্তির চেয়েও নাকি কঠিন।’
চুক্তিটি প্রকাশ পাচ্ছে যখন মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করতে বিচার প্রক্রিয়া চলছে এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে তার দেশের পার্লামেন্টে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে খালাস পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। এছাড়া ২ মার্চ ইসরায়েলে আর ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিষয়টি তো থাকছেই।
যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও অনেকবার কথিত ওই শান্তি চুক্তিটি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু নির্বাচন হলেও দু-দুবার নেতানিয়াহু সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পেরে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে দেশটিতে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। ঠিক ওই সময় শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনার দায়িত্বে কে থাকবেন তা নিয়ে তৈরি হয় সংশয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক লুসি কুরৎজার এলেনবোগেন বলছেন, ‘যে শান্তি পরিকল্পনা রয়েছে সেটি বেশ কদিন আগেই প্রস্তুত হলেও, ওই পরিকল্পনা প্রকাশের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনে ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ উপযুক্ত সময়ের আগেই সেটি বেশ কয়েকবার প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ লুসি আরও বলেন, ‘অনেকে ভাবছেন ইসরায়েলের নির্বাচনের কারণে মার্কিন প্রশাসন হয়তো ধৈর্য ধরে আছে। কিন্তু এমনটা নাও হতে পারে।’ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসরায়েলের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীকে আগেই বিষয়টি জানিয়ে রাখছে।
ফিলিস্তিনের প্রত্যাখ্যান
ট্রাম্পের কথিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’কে ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, এ চুক্তির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইসরায়েলের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, ট্রাম্প ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর তার শাসনামলে ইসরায়েলের পক্ষে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন এ চুক্তিটিও ঠিক সেসব পদক্ষেপের মতোই।
গত তিন বছরে বিতর্কিতভাবে ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করেছে। যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের দুই রাষ্ট্র নীতি থেকে সরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
ট্রাম্প তার শাসনামলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকে আর আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে না মানার ঘোষণাও দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের ফিলিস্তিন শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ কে তহবিল দেয়া বন্ধ করেছে ট্রাম্পের আমলেই। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এরকম নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ব্যক্তিগত সহকারী ও মুখপাত্র বলেন, ট্রাম্প গৃহীত যেকোনো পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যানে ফিলিস্তিনি নেতারা তাদের অবস্থানে অটল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেয়া এক বার্তায় ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মহাসচিব সায়েব এরেকাত লিখেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করেই ইসরায়েল রাষ্ট্র হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিপক্ষে যায় এমন যেকোনো প্রস্তাবনা হবে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রতারণা’।
Reminder to the International Community:Israel is an Occupying Power of the State of Palestine on the 1967 borders ( East Jerusalem , West Bank and GazaStrip ).Any deal, attempt or dictation that ignores this fact, will be recorded in history as the Fraud of the century
— Dr. Saeb Erakat الدكتور صائب عريقات (@ErakatSaeb) January 24, 2020
ট্রাম্প বলছেন, তার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সাথে ‘সংক্ষেপে’ কথা বলেছে। কিন্তু আমরা সময়ে সময়ে তাদের সঙ্গে আরও কথা বলবো এবং এ আলোচনার জন্য তাদের উৎসাহ রয়েছে। আমি নিশ্চিত, তারা হয়তো প্রথম প্রথম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাই তাদের কাছে ইতিবাচক।’
২০১৪ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়। এখন ফিলিস্তিনি নেতারা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের আলোচনায় ওয়াশিংটনকে একটা সৎ মধ্যস্ততাকারী পক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে অক্ষম। ফলে তাদের মধ্যস্ততায় আলোচনায় বসার কোনো সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের রাটার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মানবাধিকার আইনজীবী নোরা এরাকাত বলেন, ‘এ শান্তি পরিকল্পনা অসন্তোষজনক। এর মধ্যে শান্তির কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটা শান্তি নয় নিপীড়ন। ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের দমন-পীড়নমূলক অবস্থা স্থির করতে চলেছে এর মাধ্যমে।’
ফিলিস্তিনিরা চায় ইসরায়েল অধ্যুষিত পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম ছেড়ে একেবারে চলে যাক। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ওই অঞ্চলগুলো দখল করেছিল ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিরা এসব অঞ্চল নিয়েই তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
ট্রাম্পের কথিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার অর্থনৈতিক অংশটি প্রকাশিত হয় গত ২২ জুন। বাহরাইনে ওই প্রস্তাবনা প্রকাশিত হওয়ার আগে ফিলিস্তিনের নেতারা তা বয়কট করে।
ট্রাম্পের জামাতা ও তার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জেরাড কুশনার বাহরাইনে দুদিনের ওই কর্মশালায় ‘পিস টু প্রসপারিটি’ নামের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ফিলিস্তিন ও প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর অর্থনীতির গতিবৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। তিনি যুক্তি দেন এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিসর এবং লেবাননের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
ট্রাম্প জামাতার ওই পরিকল্পনায় অবকাঠামো নির্মাণ, ব্যবসা ও পর্যটনের মতো বিষয়গুলো ছিল। এছাড়া ইসরায়েলে একটি পর্যটন করিডোর নির্মাণের কথাও জানান তিনি। যে করিডোর একটি মহাসড়কের মাধ্যমে পশ্চিম তীর ও গাজাকে যুক্ত করবে। তবে বাহরাইনের রাজধানী মানামার ওই কর্মশালায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা পাঠায়নি ইসরায়েল। অন্যদিকে অন্যান্য আরব দেশগুলোও তাদের নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছিল।
পরিকল্পনার বিষয়বস্তু
এই শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। কুশনারের নেতৃত্বে ট্রাম্প প্রশাসনের একদল উপদেষ্টা ও প্রধান মধ্যস্থতাকারী জেসন গ্রিসব্লাট, সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দিনা পাওয়েল ইসরায়েল মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রাইডম্যান ছিলেন ওই দলে। পরিকল্পনাটি কয়েক ডজন পৃষ্ঠার লম্বা হলেও এর রাজনৈতিন রূপরেখা খুব গোপন করে রাখা হয়।
কুশনার বলেন, তার দেয়া শান্তি প্রস্তাবনায় ‘দুই রাষ্ট্র নীতি’ ব্যাপারটি থাকছে না। তবে আগের মার্কিন প্রশাসন এই শান্তি পরিকল্পনাকে দুই রাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতেই সমাধান করার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেই নীতি থেকে সরে আসে। ওই নীতি অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালের ৪ জুন প্রতিষ্ঠিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। যার রাজধানী পূর্ব জেরুজালেম।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিকে গত মেতে কুশনার বলেন, ‘আপনি যদি বলেন দুই রাষ্ট্র, তার মানে একটা ইসরায়েলিদের কাছে, আবার ফিলিস্তিনিদের কাছে অন্য একটা মানে দাঁড় করায়। আপনারা জানেন যে, আমরা এটাকে এরকম কিছুই বলছি না। শুধু এটা বলতে চাই, এটা যে অর্থ দাঁড় করায় তা নিয়ে কাজ করা।’
চুক্তিতে মার্কিন পক্ষের আরও একজন অন্যরকম এক কথা বলেন। ২০১৮ সালে এই চুক্তির প্রধান মধ্যস্থতাকারী জেসন গ্রিসব্লাট টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেন, ‘মূল যেসব বিষয় রয়েছে এটার মধ্যে সেসব বিষয়ের সমাধানের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে শরণার্থী ইস্যু এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা শঙ্কার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রস্তাবনা, ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টির দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী। কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনিদের প্রতিও ন্যায়বিচার করতে চাই। আমরা একটা ভারসাম্য আনার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাই উভয় পক্ষই চুক্তিতে এমন কিছু বিষয় দেখবে, যা তাদের মনমতো হবে না। এখানে কোনো নিঁখুত সমাধান নেই।’
ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা এ পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে তাদের ইসরায়েলের দখলদারিত্ব মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। এটা হলো ঘুষ। যার মাধ্যমে ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও জর্ডান উপত্যকার বেশিরভাগ অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে, যেসব এলাকা নিয়ে বিতর্ক চলছেই।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের নিশ্চয়তা নেই
এটা এখনো অজানা যে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার প্রভাব কি রকম হবে এবং এর পরের ঘটনাবলি কেমন হবে। এ পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করতে পারবে কিনা এটাও বেশ অস্পষ্ট। জাতিসংঘ ও বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের পরিকল্পনায় তা নেই।
এসএ/এমএস