রোহিঙ্গা নিপীড়নের নতুন তথ্যচিত্র প্রকাশ করল আলজাজিরা
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কীভাবে দেশটির রাখাইন প্রদেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল সে সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। গণহত্যার মতো নিকৃষ্টতম অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুটি মামলার পরপরই এই ভিডিও জনসম্মুখে এলো।
গণহত্যার উদ্দেশ্যেই ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নিধন অভিযান চালায়। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ছাড়াও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু এখনো তা অস্বীকার করেই চলেছে দেশটি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা আজ ২৪ নভেম্বর রোহিঙ্গা নির্যাতনের একটি ভিডিও ফুটেজসহ প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, শত শত রোহিঙ্গাকে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটির সেনাসদস্যরা। মিয়ানমারের সেনারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে এই নির্যাতন চালাচ্ছে।
সেনাসদস্যরা দলগতভাবে একজন একজন করে রোহিঙ্গা মুসলিমকে নানা কৌশলে নির্যাতন করছেন। কেউ বুট জুতা দিয়ে লাথ মেরে ফেলে দিচ্ছেন তো কেই বন্দুক দিয়ে তাদের শরীরের যত্রতত্র পেটাচ্ছেন। একজন মুখে লাথি মেরে ক্লান্ত হলে অপরজন এসে পুনরায় তা শুরু করছেন। বাকি রোহিঙ্গারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।
সাঈদ নামে এক রোহিঙ্গা তরুণ আলজাজিরাকে বলেন, ‘একজন সৈন্য আমার মাথা থেকে শুরু করে পুরো শরীরে লাথি মারা শুরু করে। তারপর সে বলা শুরু করে, ‘‘তোমাদের সব মুসলিমকে মেরে ফেলা হবে। আমরা অপরাজেয়’’- এমন কথা শুনে সবার মনের মধ্যে মৃত্যুর ভয় ঢুকে পড়ে।’
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ‘পানিতে পড়ে থাকা সন্তানদের লাশ তুলে আনছে তাদের পরিবারের মানুষজন।’ পরিবারগুলো জানাচ্ছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব বাড়িতে মানুষ ছিল না তাদের সন্তারা একা বাড়িতে ছিল। আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
রাজিমা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘তারা আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারপর আমাদেরকে আটক করে একত্র করে রাখে। আমাদের মুখ এমন দিকে ঘুরিয়ে রাখা হয় যাতে আমরা আমাদের বাড়ির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য না দেখতে পারি, আমরা যাতে আমাদের বাড়িঘর আগুনের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারি।’
মিয়ানমার সেনাদের হাতে ধর্ষণের স্বীকার এক নারী বলেন, ‘তারা আমাকে ধরে একটা ক্ষেতে নিয়ে যায়। সেকানে আমাকে নির্মম নির্যাতন করে তারা। পাঁচ মাস পর আমি জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। আমার পেটে বাচ্চা থাকলেও আমার কিছুই করার ছিল না।’
নির্যাতনের স্বীকার অপর এক নারী বলেন, আটক করে মানুষদের মধ্যে পাঁচজনকে তারা (সেনাসদস্যরা) আলাদা করে নিয়ে যায় একটি ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। আমিও ছিলাম তাদের একজন। ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর অন্ধের মতো তারা যা করে আমি তা বলতে পারছি না।’ এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ওই নারী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, গণহত্যা ও ধর্ষণ চালায়। তারপর রাখাইন থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তারা এখনও নিজেরে জন্মস্থানে ফিরতে পারেনি।
এর দুদিন আগে রাখাইনের রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এতে ৩০ জনের বেশি সীমান্তরক্ষীর প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনার জেরে রাখাইনের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংস সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াওয়ের অভিযোগ এনে জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে।
এসএ/এমএস