রোহিঙ্গা গণহত্যা : আইসিসির তদন্ত প্রত্যাখ্যান মিয়ানমারের
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্ত প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপে থাকার পরেও মিয়ানমার আইসিসির তদন্তকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়, নির্বিচারে গুলি করে হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়। সে সময় জীবন বাঁচাতে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা।
বৃহস্পতিবার প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন তদন্তের অনুমতি দিয়ে আইসিসির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নেদারল্যান্ডসের হেগেতে আইসিসির প্রাক-বিচারিক আদালত-৩ এক ঐতিহাসিক রায়ে এই অনুমতি দেন।
এর ফলে আইসিসির কৌঁসুলি তদন্ত শুরুর সবুজ সংকেত পেয়েছে। আইসিসির বিচারিক প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ হলেও রোহিঙ্গাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় আশা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে, আইসিসির এই তদন্তের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জাও তেই শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের ওপর আইসিসির এই তদন্ত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়টি তদন্তের জন্য মিয়ানমারের নিজেদেরই কমিটি রয়েছে। প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনীর অভিযানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। অভিযানের নাম করে সেনাবাহিনী মূলত গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালিয়েছে। জাতিসংঘের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এই অভিযানকে জাতিগত নিধনের চেষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার।
এর আগে গত সোমবার আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। এর পরেই আইসিসি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমতি দিল। অপরদিকে আইসিসির পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ‘এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপকভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়ে থাকতে পারে, যা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ির পেছনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকতে পারে। চেম্বার তাই বাংলাদেশ-মিয়ানমারের পরিস্থিতি তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে।’
আইসিসির রেজিস্ট্রি অনুযায়ী নির্যাতনের শিকার হওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবে তদন্ত শুরু করার দাবি করেছেন।
তাদের অনেকের মতামত অনুযায়ী, একমাত্র বিচার ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলেই এই ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের অবসান হতে পারে।
চেম্বারের বক্তব্য হচ্ছে, আদালত সদস্য দেশের ভূখণ্ডে কোনো অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে হওয়া অপরাধ এখতিয়ারভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
যদিও মিয়ানমার সদস্য দেশ নয়, তবে বাংলাদেশ আইসিসি রোম সনদ ২০১০ সালে অনুস্বাক্ষর করেছে। আর প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আদালত মনে করেছে যে, এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে ব্যাপকহারে সহিংসতা হয়েছে যার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জোরপূর্বক দেশত্যাগের মতো ঘটনা মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আদালত মনে করে এখতিয়ারে নেয়ার মতো অন্য অপরাধ হয়েছে কিনা তা আর পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই যদিও এ ধরণের কথিত অপরাধ ভবিষ্যতে কৌঁসুলিদের তদন্তের অংশ হতে পারে। কথিত অপরাধে যেখানে বহু মানুষ ঘটনার শিকার তার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে চেম্বার মনে করে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী প্রায় ছয় লাখ থেকে দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে বাস্তুহারা হয়ে বাংলাদেশে গেছে এমন জবরদস্তিমূলক কার্যক্রমের কারণেই। এর ধারাবাহিকতায় এমন অপরাধ বা ভবিষ্যতেও হতে পারে এমন অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আদালত তদন্ত শুরুর অনুমতি দিয়েছ।
এক্ষেত্রে দেখা হবে সেটি আদালতের এখতিয়ার ভুক্ত কিনা বা অন্তত এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের কোথাও সংশ্লিষ্ট কিনা বা অন্য সদস্য দেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কিনা বা এটা বাংলাদেশ রোম সনদে স্বাক্ষরের পর হয়েছে কিনা।
টিটিএন/এমএস