কেমন আছেন সেই ‘নাপাম কন্যা’
ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি ছবি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক চিত্রসাংবাদিকের তোলা ছবিটিতে দেখা যায়, শত্রুপক্ষের ছোড়া বোমা হামলায় আহত হয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে নগ্ন হয়ে দৌড়াচ্ছে নয় বছরের এক বালিকা।
এই ছবি দেখার পর কী করবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না নিউইয়র্ক টাইমসের এডিটররা। নগ্নতার জন্যই একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সাহস করে শেষ পর্যন্ত ছবিটা তারা ছেপেই দিয়েছিলেন পরের দিনের সংবাদপত্রে। বাকিটা ইতিহাস। একটা ছবি বদলে দেয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। ছবিটি তোলা হয় ১৯৭২ সালের ৮ জুন।
সেই মেয়েটির বয়স এখন ৫৬ বছর। বর্তমানে তিনি ইউনেসকোর একজন শুভেচ্ছা দূত এবং যুদ্ধাহত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দুই সন্তানের এই জননীর ইচ্ছা-সারাবিশ্বে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়া এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে সচেতন করা।
১৯৭২ সালে এই ছবি তোলা হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি গ্রামে। ভিয়েতনাম জুড়ে তখন ‘নাপাম বোমা’ আর কুখ্যাত রাসায়নিক বিষ ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ঢালছে মার্কিন সেনা। স্থানীয় কাওদাই মন্দির চত্বর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে রওনা দিয়েছিলেন কিম ফুক ও তার গ্রামের লোকজন। বোমারু বিমান রেহাই দেয়নি তাদের। ওপর থেকে ফেলতে থাকে নাপাম বোমা। বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারায় যায় কিম ফুকের চার প্রতিবেশী। বোমায় পুড়ে যায় তার দেহের একটা অংশ। জ্বলে যাচ্ছে! জ্বলে যাচ্ছে! এই চিৎকার করতে করতেই দৌড়াতে থাকেন কিম। সেই মুহূর্তটিই ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চিত্রসাংবাদিক নিক উট।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ওই মুহূর্ত, ওই দিনের ছবিটা নিশ্চিতভাবেই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। ছবিটা দেখলে ওই দিনের আগুনের গন্ধ, ধোঁয়া সব মনে পড়ে যায়। চারিদিকে আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম। পুড়ে গিয়েছিল আমার জামা। তখন আমার ভেতর কী হচ্ছিল, তা আমার এখনও মনে আছে। আমার নয় বছর বয়স ছিল তখন। আমার মনে হচ্ছিল, হে ঈশ্বর! আমি পুড়ে গেছি। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই ভয় থেকেই আমি প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলাম। সেই সময়ই ছবিটা তোলা হয়।’
কিমের ভাষ্য, তিনি এই পৃথিবীতে যুদ্ধের শিকার হওয়া লাখ লাখ শিশুদের মধ্যে একজন। সবাই একটু ভালোবাসা, আশা আর ক্ষমা—এই তিনটি বিষয় দিয়ে জীবন সাজাতেই পারে, কারণ এটা করা সম্ভব। আমাদের পৃথিবীতে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। একটা ছবির একটা বাচ্চা মেয়ে যদি যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে, তাহলে সবাই পক্ষেই এটা সম্ভব।’
যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও আজও পুড়ে যাওয়ার সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন ‘নাপাম কন্যা’ পান থি কিম পুক
যুদ্ধের ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখার পর থেকেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন কিম। এখন তিনি থাকেন কানাডায়। যুদ্ধে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও শুশ্রুষার জন্য খুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের জন্য তাকে ড্রেসডেন শান্তি পুরস্কার দিয়েছে জার্মানির সরকার। সেখানে দেয়া বক্তৃতাতেই এই কথাগুলো বলেছেন তিনি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে ‘রামধনু’ নামে এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করত যুক্তরাষ্ট্র। রামধনু নাম হওয়ার কারণ ছিল তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিয়েতনামে নিয়ে যাওয়া হতো গোলাপি, সবুজ, লাল, সাদা, কমলা রঙের বিভিন্ন ড্রামে। ১৯৬১ সালে এই রাসায়নিক ব্যবহারের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর পরের দশ বছরে ভিয়েতনামে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হয় সাতরঙা বিষের মধ্যে সব থেকে কুখ্যাত ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’। সবমিলিয়ে মোট সাড়ে চার কোটি লিটার ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ব্যবহার করা হয়।
রাসায়নিক দিয়ে ক্ষেত-খামার ধ্বংসের পাশাপাশি রাসায়নিক দিয়ে গাছ পোড়ানোর জন্য অভিযানেও নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই কাজে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল নাপাম বোমা। প্লাস্টিক পলিয়েস্টিরিন, হাইড্রোকার্বন বেঞ্জিন আর গ্যাসোলিন দিয়ে তৈরি এই জেলির মতো রাসায়নিক মিশ্রণ ভিয়েতনাম জুড়ে বৃষ্টির মতো বর্ষণ করে মার্কিন সেনারা। কখনও স্প্রে করে, কখনও বা সরাসরি বোমা ফেলে জ্বালিয়ে দেয়া হতো জঙ্গল, ঘরবাড়ি সব কিছুই। এই রাসায়নিকে আগুন লাগলে তা জ্বলতে থাকে দশ মিনিট ধরে, তাপমাত্রা পৌঁছায় ১০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে।
মাত্র ৯ বছর বয়সে নাপাম বোমার সেই পোড়ার যন্ত্রণা টের পেয়েছিলেন কিম ফুক। ছবিটা তোলার পরই তাকে নিয়ে হাসপাতালের ছুটে যান চিত্রসাংবাদিক নিক উট। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকেরা জানান, কিমের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। তার সারা শরীরের ৩০ শতাংশই থার্ড ডিগ্রি মাত্রায় পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি নিক উট। ১৪ মাস হাসপাতালে রেখে সারিয়ে তুলেছিলেন কিমকে। করতে হয়েছিল মোট ১৭টি অস্ত্রোপচার, তার মধ্যে ছিল পুড়ে যাওয়া ত্বক প্রতিস্থাপনও।
এই ছবি বিশ্বে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, তা নিয়ে বিব্রত হয়েছিলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। ফাঁস হয়ে যায় মার্কিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার সেই আলাপচারিতার অডিও টেপ। সেখানে নিক্সনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার মনে হচ্ছে এই ছবি সাজানো।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য সামনে আসার পর তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন নিক উট। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘আমার তোলা এই ছবি ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই সত্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা রেকর্ড করার জন্য কোনো কিছু সাজানোর দরকার নেই।’
১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর চিত্রসাংবাদিকদের বিচারে সেরা ফটো নির্বাচিত হয় এই ছবি। কিমের কথা সামনে আসায় নিন্দার ঝড় ওঠে সারা বিশ্ব জুড়ে। দেশের মাটিতেও মার্কিন সরকারের ভিয়েতনাম নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন মার্কিন নাগরিকেরা। যা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মার্কিন প্রশাসন ও মার্কিন সেনার কর্তাব্যক্তিরা। ‘নাপাম কন্যা’ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন কিম। দেশের ভাবমূর্তি তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম আগ্রাসনের তীব্রতা কমাতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র।
কয়েক বছর পর সাইগনের পতন হয়, থামে ২০ বছর ধরে চলতে থাকা কুখ্যাত ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই ২০ বছরে অবশ্য ভিয়েতনাম হয়ে গেছে এমন একটা জায়গা, যেখানে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে, মাইলের পর মাইল জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গেছে, অধিকাংশ চাষ জমি হয়ে গেছে অনাবাদী, প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ সাধারণ মানুষ।
এসআর/এমএস
সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক
- ১ তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ অবলম্বনে নির্মিত নাটকে মমতার নিষেধাজ্ঞা
- ২ ট্রাম্পের এআই উপদেষ্টা হচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত শ্রীরাম কৃষ্ণান
- ৩ বাংলাদেশের জন্য উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্য প্রতিবেশী দেশে বেচতে চায় আদানি
- ৪ নিউইয়র্কে পাতাল ট্রেনে নারীর গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা
- ৫ ইউক্রেনের একের পর এক গ্রাম দখলের দাবি রাশিয়ার