কাশ্মীরের কী হবে?
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এখন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। মোদি সরকারের ১১ দিনের মাস্টার প্ল্যানের পর আজ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিক নিজেদের শেষ স্বাধীনতাটুকুও হারালো কাশ্মীরের মানুষ। ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদটির মানুষের বিভীষিকাময় আতঙ্কে দিন কাটছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, রোববার রাত থেকে গোটা কাশ্মীরের মোবাইল-টেলিফোন নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এ ছাড়া জারি রয়েছে কারফিউ। গোটা উপত্যকাজুড়ে হাজার হাজার সেনা টহল দিচ্ছে।
ভারতের অন্যান্য অংশে থাকা কাশ্মীরিরাও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারার কথা জানিয়েছেন; বলেছেন উদ্বেগ আর আতঙ্কের কথা। দিল্লিতে থাকা কাশ্মীরের এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে স্থানীয় থানাতেও ফোন দিয়েছেন; কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও ভারতীয় সংবিধান থেকে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদাদানকারী ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কারণে বিক্ষোভ এবং সেনা সদস্যদের লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপের খবর পেয়েছে বিবিসি। এ ছাড়া সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রীসহ স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৫-ক ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নয়—এমন ভারতীয়দের সম্পদের মালিক হওয়া এবং চাকরি পাওয়ায় বাধা আছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের এমন এক স্বায়ত্তশাসন রয়েছে, যা ১৯৪৭ সালের পর দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো ‘দেশীয় রাজ্য’ পায়নি।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিলের কারণে কাশ্মীরকে ভেঙে ১ লাখ ১ হাজার ৩৮৭ বর্গকিলোমিটার নিয়ে গঠিত হবে জম্মু-কাশ্মীর। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ওই এলাকায় ১ কোটি ২৫ লাখ ৪১ হাজার ৩০২ জন মানুষের বসবাস। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে সেখানে আলাদা বিধানসভা থাকবে।
এ ছাড়া ৫৯ হাজার ১৯৬ বর্গকিলোমিটার ভূখন্ড নিয়ে গঠিত হবে লাদাখ নামে অপর একটি অঞ্চল। গত আদমশুমারি অনুযায়ী ওই এলাকার জনসংখ্যা ২ লাখ ৭৪ হাজার। এখানে কোনো পৃথক বিধানসভা থাকবে না। এটি পরিচালিত হবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
হিমালয়ের পাদদেশে অবিস্থিত নৈসর্গিক পাহাড়ি উপত্যকার পুরোটা দাবি করে আসছে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই। তবে তারা এর খন্ডিত দুটি অংশ দখল করে রেখেছি। কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ চায় স্বাধীনতা। তারা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছে।
কিন্তু কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি মানতে নারাজ ভারত। তাইতো কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। হিসাব বলছে ভারত শাসিত কাশ্মীরে প্রতি ৮ জন মানুষের জন্য একজন সেনা মোতায়েন রয়েছে।
তবে এতকিছুর মধ্যেও কাশ্মীরের মানুষ তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। তবে ভারত সরকার তাদেরকে বারবার অবরুদ্ধ করে রাখে। বেশিরভাগ সময়েই সেখানে মোবাইল-টেলিফোন নেটওয়ার্ক থাকে না। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগও।
কোনোভাবেই কাশ্মীরের মানুষ তাদের বিক্ষোভ প্রকাশ করতে গেলেই ভারতীয় সেনাবাহিনী হয় তাদের ওপর হামলা চালায়, মেরে ফেলে নয়তো গ্রেফতার করে। আর তালিকায় শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নয় আছে শিশু-কিশোররাও। তারাও ভারতীয় সেনাদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অনেক মানুষ এতদিন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার যৌক্তিকতা খুঁজে নিত। কিন্তু বিজেপি সরকার আইনি বাধ্যবাধকতাসহ সংবিধানের এ বিশেষ মর্যাদা তুলে নিয়ে পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে ঠেলে দিল।
গতকাল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ দুটির কারণে জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পেত। দেশটির সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এবং কাশ্মীরকে দুই ভাগ অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ করার বিল পাস হয়।
আজ মঙ্গলবার দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রস্তাবটি লোকসভায় উত্থাপন করেন। ৫৪৩ সদস্যবিশিষ্ট লোকসভায় ৩৬৬-৬৬ ভোটে তা পাস হয়েছে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুচ্ছেদটি বাতিল হলো এবং কাশ্মীর দুইভাগে বিভক্ত হলো।
অমিত শাহ’র উত্থাপিত বিল এবং প্রস্তাব ভারতীয় সংসদের উভয়কক্ষে পাস হওয়ার কারণে এখন থেকে জম্মু-কাশ্মীর হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। আগে শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা; এই তিনটির নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রের হাতে।
ক্ষমতাসীন বিজেপির জোটসঙ্গী কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল শিবসেনা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিল কাশ্মীরকে দেয়া বিশেষ এই সাংবিানিক মর্যাদা বাতিল করা হোক। তাইতো দ্বিতীয়বার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করলো।
পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই সংখ্যালঘু কংগ্রেস তেমন কোনো বিরোধিতাও করতে পারলো না। অথচ জওহারলাল নেহেরু ক্ষমতায় থাকতে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল অনুচ্ছেদটিতে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাই মোদিকে ঠেকানোরও তেমন কেউ নেই।
এসএ/এমএস