দুই ভাগ হলো কাশ্মীর, কী আছে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ করার পর ওই এলাকায় মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজ্যের শীর্ষ নেতাদের গৃহবন্দি করা হয়েছে। জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া খবরে বলা হচ্ছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫-এ হিসেবে পরিচিত সংবিধানের অনুচ্ছেদটি প্রথম থেকেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উপত্যকাটি এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির বিবাদের অন্যতম কারণ।
বিজেপি বহু আগে থেকেই এই আইনটি বিলোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল। অনেকেই মনে করেন, ভারতীয় সংবিধান কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেয় তার অন্যতম ভিত্তি এই আইন।
ওই অনুচ্ছেদের অন্তর্ভূক্ত অনুচ্ছেদ ৩৭০ নামে পরিচিত বিধানটি ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়।
অনুচ্ছেদ ৩৫-এতে কী বলা আছে?
সংবিধানের ৩৫-এ অনুচ্ছেদ ভারত শাসিত কাশ্মীরের আইন নিয়ন্ত্রকদের রাজ্যের স্থায়ী নাগরিক কারা তা সংজ্ঞায়িত করতে এবং কেন তারা ভারতের অন্য নাগরিকদের চেয়ে তা নির্দিষ্ট করার অনুমতি দেয়। জম্মু এবং লাদাখ সহ ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুরো অঞ্চলেই এই নিয়ম প্রযোজ্য।
তালিকাভূক্ত সকল নাগরিককে একটি স্থায়ী অধিবাসী সার্টিফিকেট দেয়া হয়, যা তাদের কর্মসংস্থান, বৃত্তি এবং অন্যান্য সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করে।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সুবিধাটি তারা পেতো, তা হলো কাশ্মীরে শুধুমাত্র সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদেরই জমির মালিকানা পাওয়ার অধিকার; যে আইনের কারণে সেখানে শুধু কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ঘরবাড়ির মালিকানা পেতে পারতো।
কারা এই অনুচ্ছেদের কারণে সুবিধা পেতো?
এই আইনটি যেদিন থেকে কার্যকর হয়, ১৪ মে ১৯৫৪, সেদিন থেকে ওই রাজ্যে যারা বসবাস করছেন এবং যারা ওই তারিখের পর থেকে অন্তত ১০ বছর কাশ্মীরে বাস করছেন- তাদেরকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
তবে স্থায়ী বাসিন্দাদের এই সংজ্ঞা রাজ্যের আইন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ দুই-তৃতীয়াংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখতো।
কীভাবে প্রবর্তিত হলো এই আইন?
১৯২৭ সালে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং প্রথমবার এই আইন প্রবর্তন করেন। উত্তরের রাজ্য পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীরে মানুষ আসা বন্ধ করতে এই আইন প্রবর্তন করেন তিনি।
ধারণা করা হয়, তৎকালীন প্রভাবশালী কাশ্মীরি হিন্দুদের দাবি অনুযায়ী তিনি ওই সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের কয়েকটি অংশে এখনও এই আইনটি কার্যকর রয়েছে। ভারতে বিলোপ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই আইনটি যেভাবে কার্যকর ছিল, তা ১৯৫৪ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল।
অনুচ্ছেদ ৩৭০-এ বর্ণিত বিধান অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরেও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে যখন জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান তৈরি হয়, সেসময় দুই বছরের পুরনো স্থায়ী বাসিন্দা আইনকে অনুমোদন করে তা।
এই অনুচ্ছেদের তাৎপর্য কী?
এই আইনটি কাশ্মীর রাজ্যের ভৌগোলিক বিশেষত্বকে সুরক্ষা নিশ্চিত করে আসছিল। যেহেতু ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য ভারত শাসিত কাশ্মীর, অনেক কাশ্মীরির সন্দেহ যে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো অন্যান্য রাজ্যের হিন্দুদের কাশ্মীরে গিয়ে বসবাসের জন্য উৎসাহ দেয়।
কাশ্মীরিদের সাথে ভারতের সম্পর্কের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে এবিষয়টি কাশ্মীরিরা কখনোই ভালভাবে নেয়নি। ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়ে আসছে।
ভারত সরকারের অভিযোগ, পাকিস্তান ওই অঞ্চলে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে হতে থাকা অস্থিরতা উস্কে দেয় - যেই অভিযোগ ইসলামাবাদ সবসময়ই অস্বীকার করে এসেছে। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মীরের পুরো অংশের মালিকানা দাবি করলেও উভয় দেশই রাজ্যটির আলাদা আলাদা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৪৭ সালে বিভক্ত হওয়ার পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্রক্ষমতা সম্পন্ন দুই দেশ নিজেদের মধ্যে দু'বার যুদ্ধ করেছে এবং কাশ্মীর ইস্যুতে একাধিকবার ছোট ছোট সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
এই আইনের সমর্থকরা কী বলছেন?
তাদের বক্তব্য, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রক্ষায় ভারত সরকার যে প্রতিশ্রুতি করেছিল, এই আইন বাতিল করে দিলে সেই প্রতিশ্রুতিকে অবমাননা করা হবে।
তারা আরো মনে করেন, এর ফলে বাইরে থেকে মানুষ গিয়ে কাশ্মীর রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে পারে, যা ওই অঞ্চলের জনতাত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করবে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি সতর্ক করেছিলেন যে, এই আইনের বিলোপ কাশ্মীরের সাথে ভারতের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে দিবে। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমকেএইচ