‘ভারতে মুসলিমদের জঙ্গি তকমা দিতে চায় বিজেপি’
মাদরাসায় শিক্ষার বদলে চলছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ; এমন মন্তব্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি। বিজেপি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে।তারা বলছে, মুসলিম সম্প্রদায়কে জঙ্গি তকমা দিতেই এমন মন্তব্য করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মঙ্গলবার সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি বলেন, সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক হিসেবে বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের কয়েকটি মাদরাসাকে জঙ্গিরা ব্যবহার করছে। তার দাবি, কিছু মাদরাসাকে প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। বাংলাদেশের নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এসব মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে বলে সতর্ক করে রাজ্য সরকারকে প্রতিবেদন দেয়ার কথাও জানান তিনি।
এদিকে, সোমবার রাতে বর্ধমানে গ্রেফতার হয়েছে বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণে অভিযুক্ত জেএমবি সদস্য আব্দুল রহিম। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০১২ সালে মুর্শিদাবাদের একটি মাদ্রাসায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদরাসাতেও রহিম প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হলে, পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি নেটওয়ার্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তখন এই মাদ্রাসা নিয়ে শোরগোল পড়েছিল। এই গ্রেফতারের পরদিনই সংসদে মাদরাসা নিয়ে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রেড্ডি।
বুধবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধী নেতারা বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে খাটো করতে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবারো সামনে এসেছে বলে মন্তব্য তাদের।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেন, সংবিধানের শপথ নিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা একটি সম্প্রদায়কে দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিচ্ছেন। তিনি নিজেও মাদরাসার ছাত্র ছিলেন জানিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়েন, যারা মাদ্রাসায় পড়ে, তারা সবাই জঙ্গি?
বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞার কথা প্রসঙ্গে আব্দুল মান্নান বলেন, বিজেপির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ আছে। তাহলে কি গোটা সাধু সমাজ, হিন্দু সম্প্রদায় সন্ত্রাসবাদী হয়ে গেল? রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তৃণমূল নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, একটি সম্প্রদায় কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য। এজন্য পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করা হয়েছে।
বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী জানান, মাদরাসায় মুসলিম ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের ছেলেরা পড়ে। আবার অনেক মুসলিম ছাত্র সাধারণ স্কুলেও পড়ে। তাহলে কাদের জঙ্গি বলব?
পশ্চিমবঙ্গে মূলত তিন ধরনের মাদরাসা আছে। কিছু সরকার স্বীকৃত ও অনুদানপ্রাপ্ত। কিছু মাদরাসায় সরকারের স্বীকৃতি থাকলেও অনুদান নেই। প্রায় সাত হাজার মাদরাসা আছে, যেগুলোর কোনো স্বীকৃতি কিংবা সরকারি সাহায্য কিছুই নেই। এসব খারিজি মাদ্রাসা বলে পরিচিত। এগুলো মুসলিমদের দানের ওপর চলে। দেয়া হয় ধর্মীয় শিক্ষা, নেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ। খারিজি মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণ নেন জেএমবি জঙ্গি আব্দুল রহিম। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নজরদারি প্রয়োজন।
দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল সন্ধি মুখোপাধ্যায় বলেন, জঙ্গি কার্যকলাপ রুখতে সর্বত্র নজর রাখতে হবে, মাদরাসা তার বাইরে নয়। তবে সেজন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তোলা মোটেই ঠিক নয়। কিছু সংখ্যক মানুষ এ সব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
রাজনৈতিক বিবাদের সমালোচনা করে অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তার মন্তব্য, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জঙ্গি মোকাবেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। এতে দেশের কোনো লাভ হবে না। বরং একে অপরের সঙ্গে তথ্য দিয়ে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টা করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অতীতে মাদরাসায় জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। একটি বিশেষ মাদরাসা সম্পর্কে নির্দিষ্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চলতে দেয়া হবে না।
পশ্চিমবঙ্গের ২৭ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সংখ্যালঘুরা স্বাধীনভাবে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারেন।তাই ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশ জুড়ে।পশ্চিমবঙ্গে আছে কয়েক হাজার মাদরাসা। এখানে মূলত দরিদ্র মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। ডিডব্লিউ।
এসআইএস/এমকেএইচ