অস্থিতিশীল সুদানকে নিয়ে সৌদি তুরস্ক মিসরের আগ্রহ কেন?
ইতোমধ্যে গুলিতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আধা সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র গ্রুপ, সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই তারা বাছবিচার না করেই পেটাতে শুরু করছে। সুদানে বড় ধরনের এই রাজনৈতিক সঙ্কট, যার জের ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, শুরু হয়েছে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। গত ৩ জুন বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর আক্রমণের নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই দেশটি এ রকম এক অরাজকতায় ডুবে গেছে।
বিরোধীদলের সমর্থকরা বলছেন, গত কয়েকদিনে ১১৩ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু সরকার ৪৬ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে।
সুদানের রাজধানী খার্তুমের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগের সাথেই চোখ রাখছে বিশ্বের বড় বড় কয়েকটি শহর; রিয়াদ থেকে কায়রো এবং আঙ্কারা থেকে মস্কো।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সুদানের রাজধানী যখন উত্তাল তখন দেশটিকে ঘিরে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর এই আগ্রহের পেছনে কারণ কী।
সৌদি-আমিরাত-মিশর
মধ্যপ্রাচ্য-জুড়ে সংঘাতের পেছনে যেসব বিষয় ও দেশের ভূমিকা রয়েছে, সুদানের সঙ্কটেও আছে সেসব দেশ। বিশেষ করে, সৌদি আরব ও তার মিত্র উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে তুরস্ক ও কাতারের বিরোধ। সৌদি আরবসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সুদানের প্রতিবেশী দেশ মিশর খার্তুমের সামরিক শাসককে বড় ধরনের সমর্থন দিচ্ছে।
এই তিনটি দেশই চেষ্টা করেছে ওই অঞ্চলে আরব বসন্তের মতো জনপ্রিয় আন্দোলন ঠেকাতে। চেষ্টা করেছে এই আন্দোলনের কোনো প্রভাবই যাতে তাদের দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। বিশেষ করে ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে দমন করার ব্যাপারে তারা খুবই সতর্ক থেকেছে।
তারা প্রত্যেকেই মনে করে, এই আন্দোলন এবং মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের মতো স্বৈরাচারী সরকারের জন্য বড় ধরনের হুমকি। সুদানের সামরিক বাহিনীকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিচ্ছে রিয়াদ এবং আবুধাবি। দেশটির বেসামাল অর্থনীতিকে সামাল দিতে ইতোমধ্যে তারা তিনশ’ কোটি ডলার ঋণ দেয়ারও অঙ্গীকার করেছে।
এ মাসের শুরুর দিকে বিরোধীদের ওপর সরকারি দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার আগে সুদানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় জেনারেলরা রিয়াদ, আবুধাবি ও কায়রো সফর করেছেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিলো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা যেসব উদ্যোগ নিচ্ছেন সেগুলোতে এসব দেশের সমর্থন নিশ্চিত করা।
গত এপ্রিল মাসে সুদানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ওমর আল-বশিরের পতনের পর দেশটিতে এসব দেশের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
তুরস্ক ও কাতার
সুদানের বিষয়ে সৌদি আরব, আমিরাত ও মিসরের অবস্থানের বিপরীতে আছে তুরস্ক ও কাতার। খার্তুমের সাথে তাদেরও আছে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। আফ্রিকার এই দেশটিতে কৃষি ও খাদ্য খাতে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে কাতার।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ওমর আল-বশিরের শাসনামলেও সুদান ও তুরস্কের মধ্যে নতুন করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে উঠেছে।
লোহিত সাগরে এক সময় অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল এমন একটি বন্দর সুয়াকিনের উন্নয়নের জন্য তুরস্ক ও সুদানের মধ্যে ২০১৮ সালের মার্চে চারশ’ কোটি ডলারের একটি চুক্তি সই হয়েছিল। সমঝোতা হয়েছিল যে, সেখানে তুর্কী নৌবাহিনীর ছোটখাটো একটি স্থাপনাও নির্মাণ করা হবে।
ওমর আল-বশির তার দীর্ঘ তিন দশকের শাসনামলে এই দুটি পক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এটা তিনি করতে পেরেছিলেন ইসলামপন্থীদের দূরে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে। ইয়েমেনে ইরানপন্থী হুতি মিলিশিয়াদের সাথে যুদ্ধে তারা সৌদি আরবকে সৈন্য পাঠিয়েও সহযোগিতা করছে।
ওমর আল-বশির হঠাৎ করেই ইরানের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেন। সুদানে ইরানের যতো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল সেগুলো আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেন। এর পরপরই ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরব সফর শেষে তিনি সৌদি আরবের কাছে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
এই সৌদি আরবের সাথে সুদানের বর্তমান সামরিক শাসকেরও রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক কাউন্সিলের প্রধান লে. জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল বুরহান। সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি লে. জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালোর সম্পর্কও ভালো।
আফ্রিকান ইউনিয়ন
সৌদি আরব, আমিরাত ও মিশর এবং কাতার ও তুরস্ক এই দুই পক্ষের কারো সাথেই সুদানের সরকারবিরোধীদের সম্পর্ক নেই। সুদানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তারা কেউই আগ্রহী নয়।
বর্তমানে দেশটিতে গণতন্ত্রের দাবিতে যে আন্দোলন বিক্ষোভ চলছে, তাতে অংশ নিচ্ছে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন। এদের মধ্যে মধ্যপন্থী, বামপন্থী এবং প্যান-আরব দলগুলোও রয়েছে। সমর্থন রয়েছে দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহীদেরও।
এই আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন। সুদানের সদস্যপদ ইতোমধ্যে স্থগিত করেছে আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং দেশটিতে বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথাও জানিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলোর এই জোট।
কিন্তু এই জোটের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিসরের সাথেই সুদানের সামরিক কাউন্সিলের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সমর্থন।এই সঙ্কটে মধ্যস্থতা করতে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবিই আহমেদ শুক্রবার খার্তুমে এসে পৌঁছেছেন। বিরোধীরা ইতোমধ্যে তার দেয়া সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
তাদের কথা, সামরিক বাহিনী এর আগেও তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে; ফলে তাদেরকে আর বিশ্বাস করা যায় না। এরই মধ্যে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করার অভিযোগে বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নেতাকেও সামরিক সরকার আটক করেছে।
রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র
সৌদি আরবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে সুদানের ওপর কিছু চাপ সৃষ্টি করেছে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর দমন-পীড়ন বন্ধ করার জন্য। তবে সুদানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ তেমন একটা নেই বললেই চলে।
গত জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটন সুদানের ওপর আরোপ করা কিছু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে দারফুরে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
সুদানের সামরিক বাহিনী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন এবং ইউরোপ অভিমুখী অভিবাসীদের স্রোত ঠেকানোর জন্য। রাশিয়া এবং চীনও এখন ওই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা দেখতে চায়।
গত কয়েক দশক ধরেই মস্কো সুদানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি বিক্রি করে আসছে। এই বিক্রির ওপর জাতিসংঘ ২০০৫ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছে খার্তুম সরকার।
সুদান ২০১৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এসইউ-৩৫ কিনেছে। এর ফলে আরব দেশগুলোর মধ্যে সুদানই প্রথম দেশ যাদের এই যুদ্ধবিমান রয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে বাণিজ্যিক কিছু স্বার্থ- বেশ কিছু রুশ কোম্পানি সুদানের আকর্ষণীয় কিছু খাতে, বিশেষ করে, স্বর্ণ ও তেলের ব্যবসায় বড় আকারের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চীনের সাথেও সুদানের সম্পর্ক বহু দশকের পুরনো। সুদানের তেল-ক্ষেত্রের উন্নয়নে বড় ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে চীন।
বর্তমানে দেশটিতে সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণেও বেইজিং সহযোগিতা করছে। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/পিআর