শ্রীলঙ্কায় কেন এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ?
শ্রীলঙ্কা এখন শোক আর দ্বিধার মধ্যে রয়েছে, বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে একটি ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এরকম একটি বেপরোয়া কিন্তু সমন্বিত আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে; ইস্টার সানডের দিনে এই হত্যাকাণ্ড একদশক আগে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে বড় হামলা।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি এর আগেও এরকম হামলা দেখেছে। আত্মঘাতী হামলাকারীদের ব্যবহার করেছে তামিল টাইগাররা। কিন্তু নতুন এই হামলার নির্মমতা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সরকারের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজিথা সেনারত্নে বোমা হামলার জন্য স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ইসলামপন্থী দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামাতকে (এনটিজে) দায়ী করেছেন।
‘এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত রয়েছে, না হলে এই হামলা সম্ভব হতো না’, সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন। কিন্তু কীভাবে ছোট একটি গ্রুপ, যাদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র বৌদ্ধমুর্তি ভাঙ্গার অভিযোগ ছিল, তারা এতো বড় ঘটনা ঘটাতে পারলো?
যদিও মঙ্গলবার ইসলামিক স্টেট গ্রুপ দাবি করেছে যে, তাদের জঙ্গি সদস্যরা ওই হামলা করেছে, কিন্তু বিস্তারিত কোনো তথ্য জানায়নি।
আইএসের এই দাবি সতর্কতার সঙ্গে দেখা দরকার, কারণ সাধারণত যেকোনো হামলার পরপরই দাবি করে থাকে। আইএস সংবাদমাধ্যম আমাক নিউজ অ্যাজেন্সিতে হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে, যা এই ঘটনায় হয়নি।
যেভাবে এনটিজের নাম বলা হচ্ছে, তা প্রশ্নের তৈরি করে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হামলার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, যা মন্ত্রিসভাকে জানানো হয়নি।
তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট এ ধরনের বার্তা পেতে পারেন, কিন্তু এ ঘটনায় তিনি সেটা পেয়েছেন কি-না, তা পরিষ্কার নয়।
একজন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে খাটো করে দেখার উপায় নেই; যিনি গত বছর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বড় ধরনের টানাপড়েনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেকে ভাবছেন, রাজনৈতিক বৈরিতা কি ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে; যার ফলে অনেক জরুরি বার্তাও যথাযথ গুরুত্ব পায় না।
সরকারের দাবি, এই আত্মঘাতী হামলাকারীরা যদি শ্রীলঙ্কার স্থানীয় হয়, তাহলে অবশ্যই এটা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বড় ধরনের ব্যর্থতা। মার্কিন গণমাধ্যম বলছে, সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নজরদারি করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট, যিনি এ ঘটনার ত্রুটি খুঁজে দেখার জন্য এর মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছেন। গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিল টাইগারদের বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী হামলা ব্যর্থ করে দেয়া এবং টাইগারদের মধ্যে নিজেদের লোক প্রবেশ করাতে পারার জন্য শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একসময় অনেক প্রশংসা পেয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার মুসলিম শত্রুতা
যখন এটা পরিষ্কার নিরাপত্তা আর রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে বোঝা যায়, তখন সেখানে শ্রীলঙ্কার সমাজের মধ্যে সাম্প্রতিক বৈরিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিল টাইগারদের হামলার শিকার হয়েছে মুসলমানরা, নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে।
তবে সংখ্যাগুরু সিংহলিজ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে সাম্প্রতিক একাধিক হামলার শিকার হওয়ার পর মুসলমান নেতারা বলছেন, শ্রীলঙ্কার সরকারও তাদের ভেতর আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। গত বছর মার্চে ডিগানা শহরে মুসলমানদের দোকান ও মসজিদে সিংহলিরা হামলা করার পর একজন মারা যান।
শ্রীলঙ্কা মুসলিম কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিলমাই আহামেদ বলছেন, ডিগানা শহরের ঘটনার পর অনেক মুসলমান নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের অনেকেই মনে করছেন যে, তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন।
ফলে এই বীতশ্রদ্ধ তরুণদের অনেকে হয়তো এনটিজের মতো গ্রুপের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে পারে। কয়েক বছর আগে বৌদ্ধ ভাস্কর্য ভাঙচুর করার জন্য এই গ্রুপটিকে দায়ী করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য এই দলের নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
গোঁড়া ধর্মপ্রচারক
এখন এটা মনে করা হচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কার পশ্চিমাঞ্চলের গোঁড়া ধর্ম প্রচারক যাহারান হাশিমের নেতৃত্বে ছোট একটি দল কয়েক বছর আগে গঠিত হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি অমুসলিমদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিদ্বেষমূলক ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তার বেশিরভাগ ভিডিও তামিল ভাষায়। তার প্রচারণায় অনেক মুসলমান তরুণ আকৃষ্ট হয়েছেন বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কায় হামলার দায় স্বীকার করলো আইএস
আহামেদ বলছেন, এই ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যম ও ইউটিউবে অনেক ভিডিওতে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অনেকে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অভিযোগ করেছেন। তিন বছর আগে একবার অভিযোগ করেছিলাম আর এ বছরের জানুয়ারিতে আরেকবার।
তবে তিনি বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো হাশিমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জানা যাচ্ছে, আত্মঘাতী হামলাকারীদের একজন এই ধর্মপ্রচারক, যদিও সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মুসলমান সমাজপতিরা বলছেন, বেশ কয়েকজন তরুণ আইএসের হয়ে লড়াই করার জন্য সিরিয়ায় গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারাও গেছে।তবে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিএ চন্দ্রাসিরি বলছেন, মুসলমানদের সঙ্গে আমাদের খুব আন্তরিক সম্পর্ক আছে। বেশিরভাগ মুসলমানই ওইসব তরুণদের মতো নয়, তারা শান্তিপ্রিয় মানুষ।
তবে জিহাদি তরুণ যারা শ্রীলঙ্কায় ফিরে এসেছেন তাদের সংখ্যা অনেক তা নয়। কিন্তু গুটিকয়েক জিহাদির যদি সিংহলিদের ওপর ক্ষোভ থেকেও থাকে, তাহলে খ্রিষ্টানদের কেন লক্ষ্য করা হলো?
শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয় ও জাতিগত উত্তেজনা থাকলেও, খ্রিষ্টানরা বরাবরই সব ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে চলে। বিশেষ করে এই ধর্মে যেহেতু সব গোত্রের মানুষই রয়েছে।
বৈশ্বিক প্রভাব
গৃহযুদ্ধ চলার সময় শ্রীলঙ্কায় বিবিসির সংবাদদাতা দেখতে পেয়েছেন, আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো শিখতে একেকজনের এক বছর সময়ও লেগে যায়। সুতরাং এটা কৌতূহলের উদ্রেক করে যে, স্বল্প পরিচিত একটি ইসলামপন্থী গ্রুপ, যাদের মধ্যে হয়তো উগ্র কয়েকজন সদস্য রয়েছে, তারা কি ছয়/সাতটি ভয়াবহ মাত্রার আত্মঘাতী হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে? যাদের একটি হামলাও ব্যর্থ হয়নি।
আন্তর্জাতিক জিহাদি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়, তবে যেভাবে বিলাসবহুল হোটেল এবং গীর্জা লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যে সুক্ষ্ণভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে স্থানীয় চরমপন্থীদের ওপর বৈশ্বিক জিহাদি নেটওয়ার্কের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না।। বিশ্বে অনেক স্থানে এরকম হামলার ধরন দেখা গেছে।
আরও পড়ুন : হাসপাতালে তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা
শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চলার সময় বিদেশি পর্যটকদের ওপর হামলা ঘটনা ছিল বিরল। কিন্তু সর্বশেষ হামলায় অনেক বিদেশি নিহত হয়েছে এবং ফলে আল-কায়েদা অথবা আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের সন্দেহ আরো বাড়ছে।
জেনারেল চন্দ্রাসিরি বলেন, ‘এরকম একটি অভিযানের জন্য বাইরে থেকে অনেক সহায়তা দরকার হয়। অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ এবং এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দরকার হয়। সুতরাং আপনি এ ধরনের ঘটনা একা ঘটাতে পারবেন না। হয়তো তারা বাইরে থেকে সহায়তা পেয়েছে।’
শ্রীলঙ্কায় সহিংসতা নতুন নয়। সত্তরের দশকে বামপন্থী বিদ্রোহ বা পরবর্তী তিন দশক ধরে চলা তামিল টাইগারদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধের ধকল বইতে হয়েছে দেশটিকে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।
তবে সর্বশেষ এই নির্মম আর সুক্ষ্ণ হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বোমা হামলার পেছনে যারা রয়েছে, তারা শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে যাচ্ছে।
## ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির শ্রীলঙ্কা প্রতিনিধি আনবারাসান এথিরাজনের বিশ্লেষণ।
এসআইএস/জেআইএম