সুদানের আল বশিরের পতনের নেপথ্যে কে এই নারী
সুদানে রুটির মূল্যবৃদ্ধির জেরে শুরু হওয়া বিক্ষোভে প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করলেও বিক্ষোভের নেপথ্যে থেকে জনগণকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছেন ২২ বছরের এক নারী। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী কণ্ঠে স্বৈরশাসক বশিরের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন সুদানের এই ‘বিউটি কন্যা’।
এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছে তিনি সুদানের নাগরিক আলা সালাহ-সুদানের গণজাগরণের মুখপাত্র। তার বিপ্লবী আওয়াজের জোরে বৃহস্পতিবার আল বশিরের রাজপ্রাসাদের ভিত নড়ে উঠেছে। এ সুযোগ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আলা সালাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যক সুদানিকে আশা জাগানোর চেষ্টা করেছি, তাদের ইতিবাচকভাবে আন্দোলিত করেছি এবং আমি অবশেষে তাদের দিয়ে উপযুক্ত কাজটি (আল বশিরের পতন) করতে সক্ষম হয়েছি।’
সালাহকে বিশ্ব মিডিয়ায় জায়গা করিয়ে দিয়েছে একটি ছবি। ছবিটি বিশ্ব মিডিয়ায় শেয়ার করার পর ভাইরাল হয়ে যায়। ছবিটি তুলেছেন লানা হারোন নামের এক ব্যক্তি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আপাদমস্তক সাদা কাপড়বেষ্টিত এক নারী গাড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখছেন। তার চারপাশে হাজার হাজার জনতা।
ছবিটির আলোকচিত্রী লানা হারোন সিএনএনকে বলেন, ‘সুদানের প্রতিটি নারী ও তরুণীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং তাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি সুদানি নারীদের গল্প শুনিয়েছেন…এবং এতে তিনি ছিলেন উপযুক্ত।’
সুদানের রাজধানী খার্তমে বিক্ষোভ চলাকালে গত সোমবার ছবিটি তোলা হয়। এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে সালাহ বলেন, ‘ছবিটি তোলায় আমি দারুণভাবে খুশি হয়েছি। যেদিন ছবিটি তোলা হয় সেদিন আমি অন্তত ১০টি সমাবেশে যোগ দিই এবং উপস্থিতিদের বিপ্লবী কবিতা পড়ে শোনাই। এটা আন্দোলনকারীদের উদ্যমী করে তোলে। এমন সময় আমি ছয়জন নারীকে ওই সমাবেশে দেখি এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিপ্লবী গান গাইতে থাকি। এটা তাৎক্ষণিকভাবে ফলও পাওয়া গেল। দেখলাম তারাও আমারে সঙ্গে গাইতে শুরু করেছে এবং জমায়েত ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল।’
স্থাপত্যের ছাত্রী সালাহ কোনো রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি। তবে তিনি কবিতা আবৃত্তি ও গান গেয়ে সুদানিদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর এসব কবিতা ও গান-সবই তার স্কুলজীবনে শেখা।
বিক্ষোভ সমাবেশে সালাহ বলতে থাকেন, ‘আমার এ দেশ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের না। এ দেশে কোনো সাম্প্রদায়িকতা স্থান পাবে না। আমার চলমান সংগ্রামের উদ্দেশ্য হলো জনগণকে অপেক্ষাকৃত ভালো সুদান উপহার দেয়া। কারণ আমার বাবা-মা আমাকে দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, দেশকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে শিখিয়েছে।’
তার বিপ্লবী কবিতার কয়েকটি লাইন এমন-‘বুলেট কখনো মানুষকে হত্যা করতে পারে না। যা পারে তা হলো এটি মানুষের দীর্ঘদিনের নিরবতা ভেঙে দিতে পারে।’
তার এ লাইনটি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে চমৎকারভাবে রেখাপাত করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীদের এ পঙক্তিটি উচ্চারণ করতে দেখা গেছে।
দেশটির স্বৈরশাসক আল বশিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় মূলত গত বছরের ডিসেম্বরে। তবে চলতি সপ্তাহে রাজধানী খার্তুমের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত মিলিটারি কমপ্লেক্সের সামনে শুরু হওয়া বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে।
এদিকে সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আহমেদ আওয়াদ ইবনে আউফ বলেন, প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করে ‘নিরাপদ স্থানে’ রাখা হয়েছে। দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী।
এর আগে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেশটির সেনাবাহিনী শিগগিরই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে বলে জানানো হয়। গত কয়েক মাস ধরেই বশিরবিরোধী বিক্ষোভ করে আসছে দেশটির মানুষ।
টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক বলেন, শিগগিরই সুদানের সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবে। এ জন্য অপেক্ষা করুন। এরপর অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণের উদ্দেশে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ এবং প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন আওয়াদ ইবনে আউফ।
তিনি জানিয়েছেন, আগামী তিন মাসের জন্য দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আগামী দুই বছর দেশটির ক্ষমতা থাকবে সেনা বাহিনীর হাতেই। নতুন এই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন আওয়াদ ইবনে আউফ। দুই বছরের মধ্যে দেশটির সংবিধানে পরিবর্তন আনা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
এক বিবৃতিতে আওয়াদ ইবনে আউফ বলেন, সুদানের জনগণ যেন সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সুদানের আকাশসীমা বন্ধ থাকবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
১৯৮৯ সালে ক্ষমতায় আসেন বশির। তারপর থেকে গত ৩০ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। গত ডিসেম্বরে দেশটির বাজারে রুটির দাম বেড়ে যাওয়ার পর থেকে বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের এই বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের আন্দোলনে রূপ নেয়। এই বিক্ষোভ থেকে বশিরের ৩০ বছরের শাসনের ভিত নড়ে গেল।
সূত্র: সিএনএন, গার্ডিয়ান, ডেইলি অ্যাকটিভ ডট ইনফো
এসআর/এমকেএইচ