ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আন্তর্জাতিক

ভারতে পতিতাবৃত্তিকে ঐতিহ্য ভাবে যে সম্প্রদায়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ২৯ মার্চ ২০১৯

ভারতে এখনও বেশিরভাগ পরিবারে মেয়ে সন্তানের চাইতে ছেলে সন্তানই বেশি পছন্দ। কিন্তু যখন হিনা জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার বাবা-মা রীতিমত উৎসব উদযাপন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই উদযাপনের পেছনে ছিল বিচিত্র একটি উদ্দেশ্য।

হিনা দেশটির পশ্চাৎপদ বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। এই সম্প্রদায়ে শত শত বছর ধরে এখন পর্যন্ত একটি প্রথা প্রচলিত আছে। যেখানে সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের পরিবারে জন্ম নেয়া সবচেয়ে বড় মেয়েকে পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। আর এই পতিতাবৃত্তি শুরু হয় মেয়ের বয়স যখন মাত্র ১০ বা ১২ তখন থেকেই।

পরিবারের পুরুষ সদস্য থেকে শুরু করে বাকি সবার জীবন ওইটুকু মেয়ের আয়ের ওপরই নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েটির আপন বাবা অথবা ভাই দালাল হিসেবে কাজ করে। যখন এই মেয়েটির বয়স হয়ে যায় তখন তার স্থলে জায়গা করে নেয় তারই ছোট বোন।

এভাবেই এই প্রথা বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের সবার গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পালন হয়ে আসছে। এই সম্প্রদায়ের বিয়েটাও হয় ভিন্নভাবে। এখানে বিয়ে দেয়ার সময় কনের পরিবার বরের পরিবারের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ দাবি করে। যেটাকে অনেকেই উল্টো যৌতুক হিসেবে আখ্যা দেন।

হিনাকে জন্মের পর থেকে এ ধরণের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং তারপরে খুব অল্প বয়সেই তাকে এই কাজে জোরপূর্বক ঠেলে দেয়া হয়।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, আমাকে যখন এই পেশায় ঠেলে দেয়া হয় তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আমাকে আমার মা ও নানীর দেখানো পথেই চলতে হয়েছে।

প্রতিদিন তার কাছে গ্রামীণ ধনী থেকে শুরু করে ট্রাক চালক পর্যন্ত একাধিক খদ্দের আসতো। তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার সাথে কত অন্যায় হয়েছে এবং ভীষণ রাগও হয়েছিল তখন। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কি বা করার ছিল? যদি আমি এভাবে উপার্জন না করতাম তাহলে আমার পরিবার কীভাবে বাঁচত?

ভারতের বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের মানুষরা দারিদ্র্যপীড়িত। পরিবারের জন্য উপার্জন এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তারা নারী সদস্যদের ওপর নির্ভর করে। স্থানীয় এনজিওর সমন্বয়ক আকাশ চৌহানের মতে, এই পেশায় আসা এক তৃতীয়াংশের বেশি মেয়ে বয়সে অনেক ছোট।

বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের লোকজন একসময় যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠী ছিল। পরে তারা কেন্দ্রীয় রাজ্য মধ্যপ্রদেশের তিনটি জেলায় ছড়িয়ে যায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষরা বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা বা মহাসড়কের পাশে থাকে, যেখানে বিভিন্ন গাড়ি বিরতি নিয়ে থাকে।

অল্প বয়সী মেয়েরা দলবেঁধে বা একলাই খদ্দেরকে নিমন্ত্রণ জানায়। এছাড়া পথের দুই পাশে প্রায়ই ছোট দোকানের মতো বুথ থাকে, সেখানে মেয়েটির দালাল হিসেবে তার ভাই বা বাবা খদ্দেরকে নিমন্ত্রণ জানায়। তারা চালকদের সাথে একটি চুক্তি করে যা সাধারণত গ্রাহক প্রতি ১০০ থেকে ২০০ ভারতীয় রুপি হয়ে থাকে। ডলারের হিসাবে সেটা দেড় থেকে তিন ডলারেরও কম।

স্থানীয়দের মতে, একটি কুমারী মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়া যায়। খদ্দের প্রতি সেটা পাঁচ হাজার রুপি বা ৭২ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে বিবিসিকে হিনা বলেন, প্রতিদিন দিনের বেলা প্রায় চার থেকে পাঁচজন পুরুষ আসে। রাতের বেলা আমরা হোটেল বা কাছাকাছি অন্য কোথাও যাই। সবসময় সংক্রমিত রোগে ভোগার ঝুঁকি ছিল।

দ্য হিন্দু নামে ভারতের একটি জাতীয় পত্রিকা ২০০০ সালে এই ধরনের চিকিৎসার অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদন করে। তারা জানিয়েছে যে, এই সম্প্রদায়ের সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্যকে পাওয়া গেছে যারা কিনা এইচআইভি পজিটিভ। সেই হিসাবে এই আক্রান্তের হার সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ।

এসব মেয়েদের অনেকেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই পেশায় আসায় কয়েক বছরের মাথায় হিনা একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়। মা হওয়ার পরও তাকে আরও বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য চাপ দেয়া হতো।

তিনি বলেন, অনেক মেয়েরা এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লেও তাদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য আরও অর্থ উপার্জন করতে চাপ দেয়া হয় তাদের। একজন যৌনকর্মী হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে, সে তার সম্প্রদায়ের মধ্যে কাউকে বিয়ে করার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তবে হিনা স্থানীয় এনজিওর সহায়তায় এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তিনি বলেন, এই জঘন্য প্রথার মধ্য দিয়ে যে মেয়েটি যায় শুধুমাত্র সেই এই সংগ্রামটা বুঝতে পারে। আমি জানি এটার অনুভূতি কেমন। তাই এই প্রথা চিরতরে উপড়ে দিতে আমি সহায়তা করে যাব।

সামাজিকভাবে অনুমোদিত এই প্রথার উৎস নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। অনেকেই বলেন, নরমেডিক উপজাতিদের বহিরাগত হিসেবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পরে তারা এই যৌন বাণিজ্যকে দরিদ্র কাটিয়ে ওঠার উপায় বলে মনে করতে থাকে।

ভারতে মেয়ের চাইতে ছেলে সন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকায় দেশটিতে লিঙ্গের অনুপাতে ভয়াবহ অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। কিন্তু বাচ্ছারা সম্প্রদায়ে এই সমস্যা পুরোই উল্টো।

এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৩ হাজার সদস্য রয়েছে যার মধ্যে অন্তত ৬৫ শতাংশ নারী। বেশি সংখ্যক নারী হওয়ার একটি কারণ হলো এই অঞ্চলে অল্প বয়সী মেয়েদের অবৈধভাবে পাচার করা হয়। পুলিশ সুপার মনোজ কুমার সিং বিবিসিকে বলেন, গত কয়েক মাসে আমরা এই এলাকা থেকে প্রায় ৫০ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছি।

এমনকি আমরা দুই বছর বয়সী একটি মেয়েকেও খুঁজে পাই। তাকে এখন একটি শেল্টার হোমে পাঠানো হয়েছে। মনোজ বলেন, তারা ঘন ঘন এ ধরণের আক্রমণ চালান কিন্তু গভীরভাবে প্রোথিত এই প্রথা শুধুমাত্র সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই শেষ করা সম্ভব।

মধ্যপ্রদেশের যেখানে এই সম্প্রদায় বসবাস করে সেখানে সম্প্রতি একটি আইন পাস করা হয়েছে। ১২ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক করলে তাদের কারাদণ্ড বাড়ানো হয়েছে। ভারতে সম্মতির জন্য ন্যূনতম বৈধ বয়স ১৮ বছর ধরা হয়। কিন্তু এই ধরনের পদক্ষেপ পরিস্থিতি পরিবর্তন আনতে পারেনি।

বাচ্ছারাসদের এই পতিতাবৃত্তির প্রথা পরিহারের উদ্দেশে ১৯৯৩ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এটি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা রাজেন্দ্র মহাজন বলেন, প্রতি বছর আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের মানদণ্ডগুলো পূরণ করতে পারেনি।

জাবালি নামের এই প্রকল্পটি মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে এই নারীদের পুনর্বাসনের উপর জোর দেবে। এতে সরকারের সাহায্যসহ বা ছাড়া পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলেও আসছে। এখন সম্প্রদায়ের অনেক অল্পবয়সী মেয়ে এই প্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্যত্র চাকরি খুঁজে নিচ্ছেন বা আরও শিক্ষা গ্রহণ করছে। এছাড়া স্থানীয় কিছু উদ্যোগও সাহায্য প্রদান করছে।

হিনাও এখন এ ধরণের উদ্যোগের একটি অংশ। এই উদ্যোগের আওতায় তাকে ২০১৬ সালে উদ্ধার করা হয়েছিল। হিনা বলেন, আমি অন্যান্য মেয়েদের বোঝাই যে তারা এখানে এলে সাহায্য পাবে এবং এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এজন্য আমার সাধ্যমত যা পারি করব।

অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয়ভাবে একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে। যেখানে ভিক্টিমদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই মেয়েদের জোরপূর্বক এই পেশায় থাকতে বাধ্য হয়েছে কারণ তাদের চাকরির অন্য কোন উপায় নেই। শুধু শিক্ষা তাদের অগ্রসর হতে সাহায্য করতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন হিনা।

টিটিএন/এমএস

আরও পড়ুন