মুহূর্তেই মসজিদে শুধু লাশ আর লাশ
হামলা শুরু হওয়ার আগে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদটি ছিল বেশ শান্ত, নীরব আর শান্তিপূর্ণ। মসজিদের ঈমাম খুতবা পড়ছিলেন। চারদিকে যেন পিনপতন নীরবতা। স্থানীয় সময় তখন ঠিক ১টা ৪০ মিনিট। আচমকা মসজিদের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শোনা যায়। আনুমানিক ২০ মিনিটের মধ্যেই খুব কাছ থেকে মুসল্লিদের গুলি করে হত্যা করে হামলাকারী।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান রমজান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে হামলার এমন বিবরণ প্রকাশ করেছে। রমজান নামের ওই প্রত্যক্ষদর্শী মসজিদের ভেতরে ভয়াবহ ও নৃশংস সেই হামলার বর্ণনা দিয়েছেন সাংবাদিকদের। তিনি জানান, হামলাকারীর হাত থেকে বাঁচতে অনেকে মেঝেতে অন্য লাশের পাশে শুয়ে পড়লেও শেষ রক্ষা হয়নি।
রমজান নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘এটা (হামলা) শুরু হয় মসজিদের মূল কক্ষ থেকে। আমি ছিলাম পাশের কক্ষে। তাই আমি দেখতে পারিনি কে গুলি করছিল। কিন্তু দেখছিলাম পাশের কক্ষ থেকে অনেকেই আমি যে কক্ষটিতে ছিলাম সেখানে ছুটে আসছেন। তাদের অনেকের শরীর রক্তাক্ত। কিছু মানুষ খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। আমি এসব দেখে বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ।’
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর নামের ওই মসজিদে বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪১ জন। তার পাশের অন্য একটি মসজিদে আরও সাতজন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির পুলিশ বলছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৮ জনের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
একজন অস্ট্রেলিয় নাগরিকসহ হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত চারজনকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ। আটক চারজনের একজন হলেন নারী। তারা এখন পুলিশি হেফাজতে আছেন। তাছাড়া একটি গাড়ি থেকে নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ বিষ্ফোরক উদ্ধার করেছে পুলিশ।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী রমজান (বামে) ও আহমেদ আলী (ডানে)
তবে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো মসজিদের ওই হামলার সময় তা ফেসবুকে লাইভ করা হচ্ছিল। আর সেটা করছিলেন খোদ হামলাকারী। হামলার পর খুব দ্রুত সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, অনলাইন ভিডিও গেমের স্টাইলে একজন বন্দুকধারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করছে।
অবশ্য সহিংসতা বিষয়ক নীতির কারণে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ভিডিওটি কিছুক্ষণ পর নামিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারী এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মাথায় রাখা ক্যামেরার মাধ্যমে তিনি সেই হত্যাযজ্ঞের ভিডিওটি লাইভ করেন বলেও জানা গেছে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সেই ১৬ মিনিটের ভিডিওতে দেখা যায়, হামলাকারী মসজিদের ভেতরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বেশ কয়েকটি বন্দুক নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে আগাচ্ছিলেন। যারা তার হামলা থেকে বাঁচতে মাটিতে শুয়ে পড়েন তাদের খুঁজে খুঁজে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করছিলেন।
হামলাকারী মসিজেদের ভেতরে ঢোকার পর থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করেন। মসজিদের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে গিয়ে প্রথম যে কক্ষটি পান সেখানে মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে টানা গুলি করা শুরু করেন। গুলির শব্দ শুনে মুসল্লিরা পালানোর চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়েন। পরে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরে ঘুরে গুলি করতে থাকেন। জীবিত মানুষ দেখলে গুলি করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
ফরিদ আহমেদ নামের আরেক ব্যক্তিও তখন মসজিদের ভেতরে ছিলেন। তিনি জানান, যখন চারদিকে প্রচন্ড গুলির শব্দ শোনা যায় তখন পরিস্থিতি বুঝে তিনি সেখানে থাকা বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়েন। তারপর কোনোমতে রাস্তা বের করে তিনি মসজিদ ভবন থেকে পালাতে সক্ষম হন।
ফরিদ আহমেদ বলছিলেন, ‘মানুষজন খুব দ্রুত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আর সেই বন্দুকধারী সেসব মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করছিলেন। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আর বাঁচার কোনো সুযোগ নেই।’
ফরিদ আহমেদ এমন মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে ফেরার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, ‘অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। আমি তখন পাশে থাকা একটি বেঞ্চ দেখতে পেয়ে তার নিচে আশ্রয় নেই। তবে আমার অর্ধেক শরীর বেঞ্চের ভেতরে থাকলেও পা ছিল বাইরে। ভয়ে আমি খুব আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম।’
ফরিদ আহমেদ জানান, ‘তিনি (হামলাকারী) সাতবার বন্দুকের ম্যাগাজিন পরিবর্তন করেন। আবার যখন বুলেট শেষ হয়ে যায় তখন পুনরায় তিনি বন্দুকে ম্যাগাজিন পরিবর্তন করেন। মসজিদটিতে অল্প কয়েকটি কম্পার্টমেন্ট ছিল। হামলাকারী প্রতিটি কম্পার্টমেন্ট ঘুরে ঘুরে সবাইকে গুলি করে হত্যা করেন।’
হুইল চেয়ারে করে নামাজ পড়তে যাওয়া রমজান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি চারদিক থেকে চিৎকার ও কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দেখি অনেকে মাটিতে মরে পড়ে আছে। অনেকে আবার ছোটাছুটি করছেন। আমি ছিলাম হুইলচেয়ারে বসা তাই আমার কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না।’
রমজান নামের ওই মুসল্লি জানান গুলিবর্ষণ চলে ছয় মিনিট কিংবা তারও একটু বেশি সময় ধরে। হামলাকারী যখন গুলি করা বন্ধ করেন তখন তিনি তার হুইলচেয়ার পেছনে ঠেলে দিয়ে স্ত্রীকে খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি দেখেন মসজিদের পুরো মেঝেতে শত শত বুলেট পড়ে আছে।
তিনি বলছিলেন, ‘আমার ডানপাশে আমি দেখতে পাই প্রায় ২০ জনের মত মানুষকে। যাদের অনেকে মরে পড়ে আছেন অনেকে আহত হয়ে চিৎকার করছেন। বামপাশে আরও দশজনকে দেখি যাদের বেশিরভাগই মৃত। আমি হামলাকারী ওই ব্যক্তিকে ভালোভাবে দেখতে পারিনি। তবে তার মাথায় হেলমেট বা এজাতীয় কিছু একটা ছিল।’
এসএ/এমকেএইচ