ভারতের ‘মুখরোচক’ সাংবাদিকতার নমুনা
কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার মুখে পাকিস্তান-ভারত পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা শুরু করে। বিমান ভূপাতিত করে ভারতীয় এক পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। কিন্তু আটকের একদিন পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংসদের একটি যৌথ অধিবেশনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা দেন, আটক ভারতীয় পাইলটকে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার নিদর্শন’ হিসেবে মুক্তি দেয়া হবে।
খবরটি শোনার পর ভারতের নেতৃস্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপক চিৎকার দিয়ে ওঠেন। তিনি দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, পাকিস্তান উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে মুক্ত করে দেবে। আর এটাকে তিনি তার চ্যানেলের এক্সক্লুসিভ স্টোরি হিসেবে দাবি করেন।
ভারতীয় ওই টেলিভিশন চ্যানেল হলো টাইমস নাউ। তারা ‘ব্রেকিং নিউজ’ নামে টিভির স্ক্রলে সংবাদটি দেখানো শুরু করে। তারপর ওই উপস্থাপক আরও একধাপ এগিয়ে বলা শুরু করেন, ‘দর্শক, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এইমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দনকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরাই প্রথম এই সংবাদ আপনাদের জানাচ্ছি।’
ঘটনাটি এক্সক্লুসিভ বলে তারা যে প্রচার চালায় তা একইসঙ্গে হাস্যকর এবং মজার। কেননা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যখন সংসদে এমন ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন গোটা বিশ্বে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। তবে নাটকের শেষ কিন্তু এখানেই হয় না। ওই উপস্থাপক আরও একজন রিপোর্টারের কাছে যান। যিনি এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয়া হলো সে সম্পর্কে কথিত এক্সক্লুসিভ স্টোরির বিস্তারিত তথ্য জানেন। উপস্থাপকের মতো রিপোর্টারও চিৎকার শুরু করেন।
রিপোর্টার দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে চাপ দেয়ায় বাধ্য হয়ে পাইলট অভিনন্দনকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তান। তারপর তিনি দর্শকদের একটি গল্প বলেন। গল্পটা এরকম, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তার আগের দিন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। রিপোর্টারের ভাষ্য অনুযায়ী, মাইক পম্পেও পাকিস্তানের সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আটক পাইলটকে মুক্ত করে দেয়া ছাড়া তাদের আর অন্য কোনো উপায় নেই।
একই চ্যানেলের নিচে ভাসতে থাকে একটি শিরোনাম। যাতে লেখা, ‘চাপে পড়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে’ মানে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান পাইলট অভিনন্দনকে ছাড়তে বাধ্য হলো। তাছাড়া আরও একটি চ্যানেলও একই শিরোনাম প্রচার করতে থাকে। কিছু কিছু চ্যানেল তো বলা শুরু করে, মোদির শক্তিশালী নীতির কাছে নতিস্বীকার করেছে পাকিস্তান। অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে যে অতিথি হাজির ছিলেন তিনি পাইলটকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণাকে ‘ভারতের জয়’ বলে অভিহিত করেন।
এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে এটা একইসঙ্গে বোধগম্য আর আশ্চর্য্যের বিষয় নয় যে, দুই দেশের গণমাধ্যমও তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এমন করেই সংবাদ পরিবেশন করবে আর তাদের মতো করে ব্যাখা দেবে। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবে ঘটনার ব্যাখ্যা হাজির করতে থাকে সেটা সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি-নৈতিকতাকে একেবারে ছোট করে ফেলে।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলোর নিজস্ব কিছু এজেন্ডা আছে। এমন সংকটের সময় উগ্র দেশপ্রেমের কিছু বিষয় থাকলেও সেটা একটা কিংবা দুটো চ্যানেলের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু তবে সমস্ত দিক বিবেচনা করে দেখলে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের চেয়ে ভারতের সংখ্যাটা অনেক বেশি। তারা যেভাবে যুদ্ধের হিস্টিরিয়া তৈরি করে ঘটনাগুলোকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে তা লক্ষ্য করার মতো।
ভারতে যারা সাংবাদিকতার বস্তুনিষ্ঠতার ব্যাপারগুলো একটু মেনে চলার চেষ্টা করেন তারাও সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিগুলো ভুলে যান যখন ভারত দাবি করে যে, তাদের বিমানবাহিনী পাকিস্তানে থাকা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানো হলেও ভারতের গণমাধ্যমগুলো হামলার ঘণ্টাখানেক বাদে জানানো শুরু করে হামলায় কয়েক শত জঙ্গি নিহত হয়েছে। অনেকে তো কোনো রকমের প্রমাণ ছাড়াই সেই নিহতের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত বলে বসে।
তাদের এই বিজয় আর উদযাপনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায় সাফল্যের খবর নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে। তাদের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্সসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। তারা পাকিস্তান সীমান্তের কথিত ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে’ হামলা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে।
অপরদিকে পাকিস্তান এই সংকটকে অনেক সতর্কতার সঙ্গে দেখভাল করে। ভারতীয় যে পাইলটকে আটক করা হয় তাকে একজন সেনার চেয়ে ছোট চোখে দেখা হয় না। কিন্তু ভারত নতুন কোনো ফন্দি তৈরি করে এ নিয়ে অন্যরকম গল্প প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আর পাকিস্তান ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করার যে প্রমাণ দেখায় তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এমনকি ইসলামাবাদের কট্টর সমালোচকরাও প্রত্যাখ্যান করেত পারে না।
ভারত উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে হিরো হিসেবে অভিহিত করছে। আর একজন সেনা তার জাতীয় দায়িত্ব পালন করলে তার প্রশংসা করার অধিকারও তাদের আছে। তবে এমন ঘটনার নেপথ্যে যেসব সত্য থাকে তা বদলে দেয়া কতটা যৌক্তিক? কেননা মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শুক্রবার পাকিস্তান যখন ভারতীয় যুদ্ধবিমানের আটক পাইলটকে মুক্ত করে দেয় তা ভারতের জন্য অপমানজনক ও পরাবাস্তব একটি বিষয়। ভারত এ বিষয়ে পাকিস্তানের প্রশংসা করতেও কুণ্ঠিত। আর এই কুণ্ঠাবোধ তৈরি করেছে দেশটির সংবাদমাধ্যম।
সূত্র : পাকিস্তানের দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে কামরান ইউসুফের লেখা কলাম। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
এসএ/জেআইএম