তালেবানের কাছে বিক্রি না করার আকুতি আফগান নারীদের
আফগানিস্তানে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা আফগান তালেবান কারোরই হার-জিত কিছুই হয়নি। অবশেষে গত বছর থেকে মার্কিন প্রতিনিধি আর তালেবান নেতাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসলে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন দেশটির ৭০০ জন নারী। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আশঙ্কার কথা জানিয়ে তারা বলছেন, ‘দয়া করে তালেবানের কাছে আমাদেরকে বিক্রি করবেন না।’
নিজেদের অধিকার নিয়ে ঠিকঠাক কথা বলতে পারেন না আফগান নারীরা। তাদের সবেচেয়ে বড় ভয় তালেবান। স্বাধীনতা কিংবা নারী অধিকারে ছিটেফেটাও তারা ভোগ করতে পারেন না। আর এতদিন ধরে চলা যুদ্ধের অন্যতম ভূক্তভোগী সেই নারীরা যুদ্ধ নিয়েও কথা বলতে পারেন না।
কিন্তু সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে তা আফগান নারীদের চরিত্রের স্বভাববিরুদ্ধ। তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতা করতে দেশের ৭০০ জন নারী একত্রিত হয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তারা বলছেন, ‘আমরা শান্তি চাই। কিন্তু সেটা আমাদের অধিকারের বিনিময়ে নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে তালেবানের যখন কথিত শান্তি আলোচনা চলছে ঠিক একই সময়ে আফগানিস্তানে গত ১৮ বছরের মধ্যে ভয়াবহ হামলা আর হতাহতের খবর আসছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী গত ১৮ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
আফগানিস্তানের মানুষরা মার্কিন-তালেবানের আলোচনার মাধ্যমে শান্তি আসবে বলে এক সন্ধিক্ষণের আশায় দিন গুণছে। তবে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় ছিল না আফগান সরকারের কোনো প্রতিনিধি।
আফগানিস্তানের অনেক নারী এই শঙ্কায় আছেন যে যদি পুনরায় তালেবান ক্ষমতায় আসে তাহলে নারীদেরকে আগের মতো আবার সেই অরক্ষিত ও বিপর্যয়কর একটা নতুন পরিস্থিতির মধ্যে জীবন যাপন করতে হবে। যেখানে তালেবানের বেধে দেয়া নিয়ম-কানুন না মানলে তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।
আফগানিস্তানের ৩৪ টি প্রদেশের নারীদের নিয়ে সম্প্রতি একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। প্রেসিডেন্ট ঘানি সেই সম্মেলেন নারীদের পক্ষে থাকার কথা বলে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আফগানিস্তানের নারীদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে তিনি সবসময় পাশে থেকে তাদের সমর্থন জুগিয়ে যাবেন।
গোটা দেশের নারীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে একজন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে যখন প্রশ্ন করেন, ‘আপনার উচিত খুনিদেরকে কারাবন্দি করা’, তখন প্রেসিডেন্ট তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন। প্রশ্নকর্তা ৪৮ বছর বয়সী ওই নারীর নাম নারগিস কুরবানি। তালেবানের সদস্যরা ১৯৯৭ সালে তার স্বামীকে হত্যা করে আর সেনাবাহিনীতে কর্মরত তার ছেলে এখন পঙ্গু।
সম্মেলনে যেসব নারী অংশগ্রহণ করেন তারা মূলত দেশটির বিভিন্ন শহর থেকে আসা। যাদের বেশিরভাগ ছিলেন মেক-আপ আর বেশ জমকালো সাজে। যেখানে নারীদের মুখ ঢেকে বাইরে বের হওয়ার নির্দেশ আছে তালেবানের। অনেকে স্কার্ফ পড়ে আসলেও বেশিরভাগ সেটা পড়েছিলেন নামমাত্র। অবশ্য একজন বোরকা পরিহিতও ছিলেন।
সম্মেলনে যোগ দেয়া নারীদের সবার হাতে ছিল ছোট ছোট পতাকা। সেই পতাকা হাতে তারা সবাই মিলে একটা গানও করেন। তালেবান শাসনের আগে যে আফগানিস্তানের মেয়েরা নতুন ফ্যাশনের পোশাক পড়তেন তার একটা ভিডিও দেখেন তারা।
বেশকিছু নারী শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ২০০১ সালের পর থেকে তারা নানারকম ঝুঁকিতে আছেন। কেননা ওই সময়ের পর থেকে তালেবানদের নীতি ভঙ্গের কারণে নারীদের নিয়মিতভাবে নানাভাবে অত্যাচার করা হতো। এ সকল নারীদের অভিমত, কথিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তালেবানদের ফিরিয়ে আনা হতে পারে।
আফগানিস্তানের ফার্স্ট লেডি রুলা ঘানি একত্রে বসে মতামত প্রকাশের জন্য নারীদের সুবিধা গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আফগান নারীরা এখন নিজেদের মত তুলে ধরছেন। কিন্তু আশরাফ ঘানির বক্তব্যে সরকারের অধীনে নারী অধিকারের বিষয়টি কীভাবে উঠে আসবে, সে রকম কোনো রুপরখো প্রকাশ পায়নি।
আশরাফ ঘানি তাকে প্রশ্ন করা এক নারীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি যে কথাটি বলেছেন তা অনেকটা একপাক্ষিক। এখন সবকিছু পাল্টে গেছে।’ তিনি ওই নারীকে আরও বলেন, ‘আপনাকে আর ভুক্তভোগী হতে হবে না। আপনি নিজেই আপনার ভবিষ্যৎ তৈরি করছেন।’
প্রেসিডেন্টের বক্তব্যটি অবশ্য সবাই আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেন। কিন্তু বেশ কয়েকজন নারী তাদের সাক্ষাৎকারে বলেন, যে কোনো শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে তারা নারী অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির নিশ্চয়তা চান।
আকিলা মুস্তাফাভি নামের ২৫ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। কিন্তু আমরা আমাদের অর্জনগুলো হারাতে চাই না। আমাদের এই অবস্থানে পেঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আমরা এখান থেকে আর ফিরে যেতে চাই না।’
মার্কিন প্রতিনিধি ও তালেবান নেতারা নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে থাকা সকল মার্কিন ও অন্যান্য দেশের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।
আফগান সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি এবং অন্যান্য বিষয়ে সরাসরি আলোচনায় বসতে চান তারা। তবে সরকারের সাথে আলোচনার ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছেন তালেবান নেতারা। যদি সরাসরি আলোচনায় বসতে হয় তাহলে আফগান নারীরাও সেখানে অংশ নিতে চাইবে বলে তালেবানরা জানায়।
শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে আগামী ১৭ মার্চ আফগানিস্তানের ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান লয়া জিরগা ঘোষণা করেছেন আশরাফ ঘানি। যেখানে আফগানিস্তানের নাগরিকদের বিশাল একটা অংশ সম্মিলিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই অনুষ্ঠানে যারা উপিস্থিত থাকবেন তাদের ৩০ শতাংশই হবে নারী।
আফগান প্রেসিডেন্ট ঘানি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্দেশে দেয়া এক বক্তব্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি তালেবান আক্রমণকে প্রতিহত করতে সেনাবহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।
আফগান সরকারের গঠিত হাই পিস কাউন্সিলের এক সম্মেলনে পরিষদের সদস্য মালালাই শিনওয়ারি বলেন, লয়া জিরগাতে অংশগ্রহণের জন্য গোটা দেশের ১৫ হাজার নারী প্রস্তুত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের মেয়েরা এখন সব পারে।’
সূত্র : মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত কলাম। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
এসএ/জেআইএম